• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:মার্চ || ০৯:১৯:২৭
প্রকাশের সময় :
এপ্রিল ১২, ২০২২,
১১:২৩ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ১৩, ২০২২,
১০:১৬ অপরাহ্ন

৩২৬ বার দেখা হয়েছে ।

চারুকলা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপমান করা হচ্ছে : হাশেম খান

চারুকলা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপমান করা হচ্ছে : হাশেম খান

মাধ্যমিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষায় বৈষম্য নিরসন ও সৃষ্টিশীল জাতি গঠনের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সাল থেকে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চারু ও কারুকলা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শী পরিকল্পনার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিষয়টি চালু হয়েছে, তা ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিকের চারুকলা শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চারুশিল্পী, চারুকলা শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ শিল্পীদের একাধিক সংগঠন নানা মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসছে। কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত না নিয়ে চারুকলার একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে বলে অভিযোগ সচেতন শিল্পী সমাজের। এ রকম নানা বিষয় নিয়ে মাধ্যমিক স্তরের চারু ও কারুকলা বিষয়ের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির সভাপতি শিল্পী হাশেম খানের সঙ্গে দেশক্ষণের সঙ্গে কথা বলেছেন ।

দেশক্ষণ : সৃজনশীল শিক্ষায় চারু ও কারুকলার মতো একটি সৃষ্টিশীল ও আনন্দদায়ক বিষয় পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত বলে আপনি মনে করেন?

হাশেম খান : যারা এটা (চারু ও কারুকলা) বাদ দিয়েছে, তারা বিষয়টা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। শুধু এ বিষয় সম্পর্কে নয়, আমার তো এখন মনে হচ্ছে এই শিক্ষানীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের এই অজ্ঞতা কিন্তু একেবারে ক্ষমার অযোগ্য। তার কারণ, সত্যিকারের একটি স্বাধীন দেশের ছেলেমেয়েরা কীভাবে বড় হবে, কীভাবে সুশিক্ষিত হবে, সেটা তাদের জানা নেই এবং তারা সেটা নিয়ে ভাবেও না। তারা নিজেরা পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে যতখানি না পরিচিত, কিন্তু তাদের পাণ্ডিত্য নিয়েও আমার এখন রীতিমতো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, তাদের বক্তব্য আমি শুনেছি আরও কয়েক জায়গায়, আমি প্রতিবাদও করেছি। যেমন একজন (তাকে আবার সবাই বলে আলোকিত মানুষ) তিনি এবং আরও দুজন খুব পরিচিত, শিক্ষানীতির সঙ্গে জড়িত। তারা অনেক উপদেশ দিয়ে থাকেন, অনেক সভা-সমিতি করেন, অনেক বক্তৃতা দেন। তারা তিনজন কক্সবাজারে গিয়ে এই চারুকলাকে কেন আবশ্যিক করা হলো, এটা ছেলেমেয়েদের অসুবিধা হয়, এই হয়-সেই হয়, এটা একটা মাথাধরা বিষয়। এসব বলে আবশ্যিক বিষয় থেকে বাদ দিয়েছেন। অথচ যে কারণে এটা ঢোকানো হয়েছিল, সেটা তারা মোটেই বিবেচনা করেননি, জানেনও না তারা যে চারুকলা কোনোরকমভাবেই কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। কারণ, শিশুরা এটা আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করে। এর মধ্যে মুখস্থ নেই, এর মধ্যে চাপাচাপির কিছু নেই, এর জন্য টিউটর রাখতে হয় না। ক্লাসে যদি একজন ভালো শিক্ষক থাকেন, সিলেবাসটা এমনভাবে করা হয়েছে এবং শিক্ষক নির্দেশিকাটাও এমনভাবে করে দেওয়া হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে ছবি আঁকে। আর এই ছবি আঁকার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সব স্তরেই কোমলমতি শিশুরা কিন্তু নিজেকে ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার একটা সুযোগ পায়, আগ্রহ পায়, আনন্দ পায়। কারণ যে শিশু ছবি আঁকতে যায়, সে গাছ আঁকুক, মানুষ আঁকুক বা আমাদের বাংলাদেশের কোনো ফুল আঁকুক, ফল আঁকুক, যদি ব্যাগ আঁকে, যদি নদী আঁকে, সূর্য আঁকে; এই যে বিষয়গুলো সে আঁকছে, এ আঁকার মধ্য দিয়ে সে নিজে নিজেই কিন্তু এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারছে, চর্চা করতে পারছে। সে ভালোবাসতে পারছে গাছকে, ভালোবাসতে পারছে নদী-নালা, পশু-পাখিকে। ছবি আঁকার মাধ্যমে একজন শিশু কিন্তু সুনাগরিক হয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এসব ব্যাখ্যা সব দেওয়া আছে শিক্ষক নির্দেশিকায়। আমার মনে হয়, এই পণ্ডিত ব্যক্তিরা বিন্দুমাত্র পড়েন না। কারণ, তারা যা জানেন তারা মনে করেন, যা শিখেছেন সেটাই তাদের পৃথিবী এবং সেটাই তাদের জ্ঞান।

দেশক্ষণ : প্রায় ২২ হাজার এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারুকলা শিক্ষকশূন্য। কিন্তু এ পদে প্রথম নিয়োগে বয়সসীমা নির্দিষ্ট করার ফলে চারুকলার হাজার হাজার দক্ষ জনবল আবেদনের প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হচ্ছেন।

 

হাশেম খান : এটাও বলব যে অজ্ঞতা। এরা চারুকলা শিক্ষাকে অনান্য বিষয়ের সঙ্গে এক করে ফেলে। আমি বলি, চারুকলা শিক্ষা, সংগীত শিক্ষা, অঙ্ক শিক্ষা এক বিষয় নয়; এটা (চারুকলা) সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। চারুকলায় যত বয়স্ক শিক্ষক হবে, যত অভিজ্ঞ শিক্ষক হবে স্কুলে ততই এই শিক্ষাক্ষেত্রগুলো বেশি উপকৃত হবে। এখানে সরকারি হোক, বেসরকারি হোক আমার মনে হয় তার শেষ বয়সসীমাটা (অবসরের বয়স) থাকবে কিন্তু সে যদি পাঁচ বছরও শিক্ষকতা করতে পারে, সে যদি অভিজ্ঞ হয়; এখানে শিক্ষকদের এই বয়সের বার (বাধা) তুলে দেওয়া উচিত। বয়সের বার থাকলে আমরা অভিজ্ঞ শিক্ষক পাব না। আমাদের অভিজ্ঞ শিক্ষক দরকার। যেকোনো বয়সেই (অবসর গ্রহণের আগে) সে জয়েন করতে পারবে। কারণ, আমাদের বাস্তবতাকে দেখতে হবে। অবাস্তব জিনিস দিলে তো হবে না। যারা এসব নীতি করেন, তাদের বাস্তবতার নীতি মেনে করতে হবে। আর এসব নীতি করার জন্য অবশ্যই সিনিয়র কোনো শিল্পী-বিশেষজ্ঞ থাকা উচিত।

দেশক্ষণ : বর্তমানে এমপিওভুক্ত কিছু বেসরকারি বিদ্যালয়ে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রিধারীরা অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতা করছেন। নীতিমালার শর্তে তারা তো বাদ পড়বেন।

হাশেম খান : না, না, এটা তো খুব অন্যায়, অন্যায় হবে। একদিকে শিক্ষক নেই আবার অন্যদিকে প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের বয়সের কারণে বাদ দেওয়া হবে, এটা সাংঘর্ষিক ব্যাপার। সে জন্য বয়সের বার (বাধা) তুলে দেওয়া উচিত। এটার জন্য রীতিমতো শিল্পীদের আন্দোলন করা উচিত। কারণ, এটা শিক্ষানীতির অজ্ঞতা।

দেশক্ষণ : সম্প্রতি সংশোধনী নীতিমালায় (২০২১) চারুকলা শিক্ষক পদে আবেদনের শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে যেকোনো বিষয়ে স্নাতক/সমমানসহ এক বছরের চারুকলা ডিপ্লোমা কোর্সকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আপনি কি মনে করেন যে মাধ্যমিকে চারু ও কারুকলার পাঠদানের ক্ষেত্রে এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্সটি যথেষ্ট?

হাশেম খান : না, এটা একেবারে ভুল সিদ্ধান্ত, এটা অজ্ঞতা। যারা করেছেন তাদের চিত্রকলা শিক্ষা সম্পর্কে একেবারেই কোনো জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে তারা এটা করত না। এত বছরের শিক্ষায় ছবি আঁকা কী শিখবে সে? পাঁচ বছরের প্র্যাকটিক্যাল ও থিওরিটিক্যাল শিক্ষা এক বছরে কী করে হয়? এদেরকে তো আমি চারুকলার অর্ধশিক্ষিত বলতে পারি না। এক বছরে অর্ধও হয় না। এক বছরের শিক্ষা কোর্স কে করল? এখানে কীভাবে তাকে এক্সপার্ট বানাল? এখানে তো সন্দেহ থেকে যাচ্ছে! এই শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা চারুকলার কী শিখবে? বরং ভুল শিখবে। এখানে অন্য বিষয়ে জ্ঞানের থেকে আমাদের চারুকলায় যারা পাঁচ-ছয় বছর পড়েছে তাদের দরকার। এই যদি হয়, তাহলে চারুকলার ইউনিভার্সিটিতে চারুকলার যে শিক্ষা, এটার প্রয়োজন বোধ হবে না। তার মানে কী? আমাদের চারুকলা শিক্ষাকেই তো অপমান করা হচ্ছে। জাতীয়ভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের চারুকলা শিক্ষাকে অপমান করা হচ্ছে। এদেরকে (এক বছরের চারুকলা ডিপ্লোমাধারী) দিয়ে কোনো দিনও সম্ভব হবে না। এদের শিক্ষক করা, না করা, পরে আরও গোলমালে পড়বে। আমাদের শিশুরা কোনো কিছুই শিখতে পারবে না। এটা অবাস্তব, এসব ভুয়া। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করছি। যারা এটা (ডিপ্লোমার অনুমোদন) করেছে তারা চারুকলার মানুষগুলোকে বেকার করবে। এই চারুকলার (প্রাথমিক/মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক) সবকিছু আমি এবং আমার শিক্ষকরা মিলে করে দিয়েছি। কিন্তু আজ এক বছরের ডিপ্লোমাধারীদের শিক্ষক বানাবে? আমাকে জিজ্ঞেস করল না! আমি জানলামও না!

দেশক্ষণ : কিন্তু ডিপ্লোমাধারীদের ভাষ্যমতে, “তারা তো শিক্ষক নিবন্ধন পাস করে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই এ পদে আসবেন।”

হাশেম খান : শোন, এটা (চারুকলা) তো প্র্যাকটিক্যাল জিনিস, প্র্যাকটিক্যাল শেখাতে হয়, এটা পরীক্ষার কোনো বিষয় না। কথা হলো যে, ড্রইং, ডিজাইন ইত্যাদি এক বছরে কিছুই শেখা যায় না। এটা হলো আসল কথা। তারা যে শেখাবে এগুলো ব্যাকরণগত জিনিস, পারসপেকটিভ, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এগুলো এক বছরে শেখা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নিয়ম নেই। এটা হলো আমাদের শিক্ষানীতির অজ্ঞতা, মূর্খতা।

দেশক্ষণ : আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, “চারুকলা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সিলেবাস আর্ট কলেজের সিলেবাসের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।” অভিযোগটি খতিয়ে দেখা উচিত নয় কি?

হাশেম খান : হ্যাঁ, খতিয়ে দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে যারা শিশুদের ছবি আঁকায় বিশেষজ্ঞ এবং চারুকলাতে যারা ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিংয়ে বিশেষজ্ঞ; এখানে চারুকলার সিনিয়র শিক্ষক এবং শিশুদের শিল্পকলা শিক্ষায় যারা অভিজ্ঞ তাদের দিয়ে সিলেবাস করানো উচিত।

দেশক্ষণ : ইতিমধ্যে চারুকলা শিক্ষক নিবন্ধনে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের দ্রুত নিয়োগ না দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিয়োগের পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এই যে চারুকলার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের এমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কী বলবেন?

হাশেম খান : আমি এগুলোর (দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা) তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এগুলো চারুকলা শিক্ষা এবং শিক্ষাকে নিরুৎসাহী করা। যারা এটা করেছেন তারা চাকরি করেন, তারা দেশকে ভালোবাসেন বলে আমার মনে হয় না। এগুলো যেন না করা হয়, এগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এগুলো আমাদের এগিয়ে দেবে না, বেকার সমস্যা বাড়াবে।

দেশক্ষণ : আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছর (সেশনজটসহ সাত-আট বছর) পড়েও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চারুকলা শিক্ষক পদে এখন আর আগের মতো আবেদন করতে পারছে না।

হাশেম খান : কেন পারবে না?

দেশক্ষণ : এ জন্য বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

হাশেম খান : এটা এর আগে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। আমরা বুঝিয়েছি। এদের (চারুকলা শিক্ষার্থী) বিএডের প্রয়োজন নেই। এটা বাড়তি। এরা বিএডের থেকে বেশি পারদর্শী হয়ে যাচ্ছে প্র্যাকটিক্যালভাবে। কারণ, বিএডের অনেক কিছুই আমাদের চারুকলার মৌলিক শিক্ষার মধ্যেই আছে।