• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ১৪:৩০:০৭
প্রকাশের সময় :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:০১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:০১ অপরাহ্ন

২২৫ বার দেখা হয়েছে ।

বৃষ্টিকাতর

বৃষ্টিকাতর

আকাশ ভয়ানক শব্দে ডেকে উঠলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠি। ১৩ দিন হলো মফস্বল শহরে এসে জয়েন করেছি। তখনো ছেলে মিনহাজের ক্লাস টুয়ের পরীক্ষা শেষ হয়নি বলে বাবাসহ আমার স্ত্রী কেয়া শখানেক কিলোমিটার দূরে ঘিঞ্জি শহরটাতেই থেকে গেল। তিন দিন পরে তারা রওনা দেবে।

ওয়াপদা কলোনির সি-টাইপ বাসার বারান্দার ওপরে ঢালু ঢেউখেলানো টিন। পাশে বিশাল গন্ধরাজের গাছ। রাতের গন্ধের তীব্রতা দিনেও আনাগোনা করে। গ্রিল ধরে দাঁড়াই। বাইরের উজ্জ্বল রোদ চোখের সামনেই মিইয়ে আসে। তারপর শুরু হয় উথালপাতাল বাতাস। কলোনির ওপর দিয়ে যেন একটা ঘূর্ণি যাচ্ছে! ধুলার স্রোতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন তখন। কিন্তু ঘরে ঢুকতে গিয়ে কানে আসে বারান্দার ছাদে বৃষ্টির ঝমঝমে শব্দ। পানি পড়লে ধুলা আসবে না, এই ভেবে বারান্দায় দাঁড়াই। হাঁটুর নিচ থেকে প্যান্টটা মুহূর্তে ভিজে যায়। একা হলে নাকি মানুষের ভেতরটা বেরিয়ে আসে। ভাবতে অবাক লাগে, জীবনে এই প্রথম নিজের ইচ্ছাতে বৃষ্টিতে ভিজছি!

বৃষ্টির পানির নির্দিষ্ট কোনো দিকনিশানা নেই। একবার বাঁ দিক থেকে আসে তো পরপরই সামনে বা ডান দিক থেকে। অথচ আমি নড়ি না, নিজেকে বাঁচানোর এতটুকু চেষ্টা করি না। ফোঁটায় ফোঁটায় শার্টের ওপরে বলপ্রিন্টের মতো হয়ে যায়। মনে পড়ে একবার মেঘের গর্জন কানে আসতেই মা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলেছিল, ‘উঠোন থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয় তো তাড়াতাড়ি!’ বড় ফোঁটা দু-একটা পড়তে দেখেও আমি আগে শেলফের কাছে গেছি ছাতা খুঁজতে। তারপর সেটা মেলে দৌড়ে যেতে যেতে দড়িতে মেলে রাখা শাড়িতে বলপ্রিন্টের জলছাপে ভরে গেছে। এলোপাতাড়ি বৃষ্টি আর বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দড়ি আঁকড়ে রাখা ক্লিপ খুলেছি, নিজেকে ভেজাব না বলেই শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো ভিজিয়েছি অনেকটা। সেই তখন থেকে জানি, বৃষ্টিতে ভিজতে আমার ভালো লাগে না। পানিটা কেন যেন খামাখাই বড্ড ঠাণ্ডা। সামান্য মেঘলা দিনে স্কুলে না যাওয়ার ছুতা খুঁজতাম। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা দেখলে জানালা আটকে অপেক্ষা করতাম। আজ একাকিত্বে এমন কী হয়ে যায় যে বৃষ্টির ছাঁটে গা ভেজাতে আমার বেশ লাগে!

আজই মোটে কেয়াকে মেসেজে লিখেছি, তাড়াতাড়ি আসো। এখানে বিশুদ্ধ বাতাস, গোয়ালার খাঁটি দুধ, বাসার দেয়ালের পাশ থেকে ধুন্দল তুলে এনে রেঁধে খাওয়া, জানালা দিয়ে পদ্মা নদী দেখা…আর কী চাও! বাবার না পদ্মার ইলিশ প্রিয়? দেখব এবার কত খাবে! আর ধুন্দল তোমার প্রিয়, না দেখলে বিশ্বাস করবে না, ঘন বর্ষায় ধুন্দলের লকলকে লতা একতলা বাড়িটাকে মনে হয় গিলে খাবে! বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হঠাৎ মনে পড়ে আরেকটা কথা লেখা দরকার, যা দেখলে কেয়া যারপরনাই অবাক হবে, লিখব, তোমরা এলে এই বর্ষায় একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব। মিনহাজকেও নেব, ভাপসা গরমে একবেলার বৃষ্টিতে ভিজলে কি জ্বরটর হয়ে যাবে?

মেসেজটা পড়ে কেয়া খানিকক্ষণ থমকে থাকবে…বৃষ্টিতে ভেজার আহ্বান! কেয়ার চোখগুলো বড় বড় হবে এই ভেবে যে আমার আবার কী হলো! অবশ্য কেয়া এমনটা ভাবতেই পারে। চিরকাল আমি তার বৃষ্টিতে ভেজার আবদার উড়িয়ে দিয়েছি। শুধু উড়িয়ে না, উল্টো বকাবকিও করেছি। বলেছি, বাথরুমে শাওয়ার নেই, কেয়া? সেইটাতে কি বৃষ্টির চেয়ে কম পানি পড়ে? ওইটার ওপর তোমার নিয়ন্ত্রণও আছে, বাড়াইলে বাড়াও আর কমাইতে চাইলেও তা-ই করো। বৃষ্টিতে আধাভেজার পরে রোদ উঠবে। আবার মোটেও ভিজতে না চাওয়ার দিনে কাকভেজা হয়ে ফিরবে।

ভাবতে গিয়ে মনে আসে, আচ্ছা, কমবেশি সব পাখিই তো বৃষ্টিতে ভেজে, নাম কেন হয় শুধু কাকের? ঠিক আছে, কাক ভিজুক। কেয়া অবশ্য আমাকে একদিন একেবারে মোক্ষম প্রশ্নটি করেছিল, বৃষ্টিতে ভিজলে কি মানুষ আর শুকায় না? মানে, ভেজার পরে তুমি নিজেকে মুছে ফেলতে পারবা না? শরীর হিম হয়ে শার্ট আর প্যান্ট থেকে যখন ফোঁটা ফোঁটা পানি বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন কেয়ার প্রশ্নের কথা ভেবে আমার হাসি পায়। আমি কেন এত দিন তার কথা শুনিনি? আহা আফসোস, কত আনন্দেরই না হতে পারত একসঙ্গে ছাদে-বারান্দায় কিংবা রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা, অন্তত যতবার কেয়া প্রস্তাব দিয়েছিল। একবার ঝমঝমে বৃষ্টি কমে এলে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িতে লাল চাদর হওয়া ফুটপাতে কেয়া বারবার ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি ছাতা হাতে তার পেছনে ছুটছিলাম, কী পাগলামি করতেছ, সর্দিকাশি ধরবে আর রাস্তায় এ রকম করলে লোকে কী বলবে বলো তো? আমি কিন্তু তোমার পেছনে আর দৌড়াব না বলে দিলাম, ভিজবা।

ভিজতেই তো চাচ্ছি। তোমার অত্যাচারে পারতেছি না।

নিজেকে শুকিয়ে নিয়ে বেশি কাঁচা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মাখি। বিছানায় আয়েশ করে বসে মেসেজটা কেয়াকে পাঠাই। সে দেখার পরের কয়েক মিনিট উত্তর নেই। জানি, থমকে আছে। হয়তো ফোন করে খানিক বকবক করবে। কিন্তু বেশ খানিক বাদে কেয়ার মেসেজ আসে,

‘আমার সুখের মাঠ জলভরা

আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!

এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে

আমার জন্মের কোনো শেষ নেই। ’

আমি গল্প-কবিতা পড়ি না, ওসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। অথচ লাইনগুলো আমি বারবার পড়ি। বৃষ্টি গায়ে মেখে কি আমার আরেকবার জন্ম হলো? চাইলে কেয়ার কাছে জানতে চাইতে পারতাম—কবিতাটা কার লেখা? চাই না। কী যায় আসে, বরং বারান্দার চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে আমি শুয়ে শুয়ে ভাবি, আশ্চর্য, এই মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে যে এই কবিতাটা পড়েছে!

বিরতিহীন বৃষ্টির শব্দে বা বিরতির নৈঃশব্দ্যে ক্রমাগত কেয়াদের অপেক্ষায় তিনটা দিন কাটে। যেদিন তারা আসবে সেদিন ছুটি। সকালেও আলো ফোটে না বলে ঘুমিয়েই থাকি। শেষে ড্রাইভারের কলিংবেলে ঘুম ভাঙে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসি, অফিসের গাড়ি নেওয়ার আবেদন করেছিলাম বাসস্ট্যান্ড থেকে কেয়াদের আনব বলে। উঠে ঘড়ি দেখি, তত দেরি হয়নি। এখনো তাদের পৌঁছতে ঢের বাকি। সারা রাতের বৃষ্টির পর চারদিকটা অদ্ভুত ভেজা ভেজা। মেঘ লেপা আকাশের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য উঁকি দেয়। দিনটা হঠাৎ যেন অন্য রকম হয়ে যায়। বউ-বাচ্চা ছেড়ে কখনো এত দিন থাকিনি। ভেতরে ভেতরে তাদের ফিরে পাওয়ার উত্তেজনা। কেয়ার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়, শহরের কাছেই চলে এসেছে প্রায়। গাড়িতে বসে গুনগুন করে বেসুরো গান ধরি।

বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে গাড়িতেই বসে থাকি। ড্রাইভার হঠাৎ ছুটতে ছুটতে আসে, স্যার, এরা বলতেছে, শহরে ঢোকার রাস্তায় বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ধইসা ওদের বাস নাকি উল্টাইয়া গেছে। রাত ভইরা বৃষ্টি তো, স্যার, সারা শহরে পানি…

টানা বৃষ্টিতে পানি আটকে বন্যার কথা শুনেছিলাম বটে। কেয়ার টেলিফোন বাজে না। বাবারও না। গাড়ি দ্রুত ছোটাই শহরের প্রান্তে ধসে যাওয়া রাস্তার এলাকার দিকে। রক্তাক্ত রাস্তার ওপরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে। পানিতে মিশে চাপ রক্ত লালচে গোলাপি হয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে কোথায় যেন চলে যায়! বাসটা দুইবার উল্টেপাল্টে পাশের ডোবায় পড়েছে। বৃষ্টি মাথায় দাঁড়িয়ে দেখি ডোবা থেকে টেনে তোলা দ্বিতীয় লাশটা কেয়ার। বাসের ভেসে থাকা অংশে কী করে যেন সারা শরীরে জখম নিয়ে বাবা তার রক্তাক্ত নাতিকে বুকে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করে। বাসটা রাস্তার দিকে টেনে আনলে অর্ধমৃত শরীর দুটি নিয়ে হাসপাতালে ছুটি। দুপুর পর্যন্ত রক্তের জোগাড়, দুটি কেবিন আর অপারেশন থিয়েটার, ওষুধের দোকান আর ডাক্তারের চেম্বারে পালাক্রমে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার কেয়ার লাশের কথা মনে থাকে না। সন্তানকে বাঁচানোর জন্য অপরিচিত লোক সামনে পেলেও জানতে চাই, রক্তের গ্রুপ কি এবি পজিটিভ?

বিকেল পড়ে এলে লাশ নেওয়ার জন্য ফোন আসে। প্রায় জীবিত মানুষ মৃতের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগের দাবিদার। তাইতো আমি বেমালুম ভুলে ছিলাম কেয়ার কথা! গিয়ে দেখি হাসপাতালের সুনসান বারান্দায় মৃতদের সঙ্গে অবহেলাভরে কেয়া শুয়ে আছে। মুখ দেখি না, পায়ে ঝোলানো নম্বর দেখি শুধু। ঢেকে রাখা সাদা কাপড়টা বৃষ্টির ফোঁটায় বলপ্রিন্ট হয়ে আছে। বারান্দার বাইরের দিকে খানিক বেরিয়ে আসা পায়ের দিকটা ভিজে গেছে প্রায়। কে যেন এসে জানতে চায়, কে হয় আপনার, বউ? মুখের দিকে না তাকিয়ে ওই অপরিচিত কণ্ঠস্বরকে আমি উত্তর দিই, আমার বউটার খুব বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল।