• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার:২০২৪:এপ্রিল || ১৩:১৯:১২
প্রকাশের সময় :
মে ২৪, ২০২২,
৬:২৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ২৪, ২০২২,
৬:২৭ অপরাহ্ন

২৪৮ বার দেখা হয়েছে ।

সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সংকট

সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সংকট

নীলাঞ্জন কুমার সাহা

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, জিডিপি, আর্থ-সামাজিক সূচক, করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনা, প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এর পাশাপাশি বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের সীমিত আয় দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, আয়ের উৎসগুলো আরও সংকুচিত হওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ভাবনা একটি গম্ভীর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাড়তি একটু আয়ের আশায় সীমিত আয়ের মানুষেরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের কিছু অংশ সঞ্চিত করে বিভিন্ন প্রকার আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেন, যাতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে না হয়।

এই কারণেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত চাকরিজীবী, নারী, বয়স্ক নাগরিক এবং অবসরে যাওয়া ব্যক্তিবর্গের একটি বড় অংশ তাদের পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর উৎসে বিদ্যমান ১০ শতাংশ করের হার এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের উপর প্রায় ২ শতাংশ হারে সুদ হ্রাসের কারণে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ থেকে আয়ও ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে।

বাড়তি একটু আয়ের আশায় সীমিত আয়ের মানুষেরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের কিছু অংশ সঞ্চিত করে বিভিন্ন প্রকার আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেন, যাতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে না হয়।
তাছাড়া, বিনিয়োগের ধাপ ও এর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের ফলে সীমিত সঞ্চয়ের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্রের বিকল্প উৎস খুঁজতে বিনিয়োগ ভাবনার এক গভীর সংকটে পড়েছেন।

সঞ্চয়পত্রের বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে অনেকেই ব্যাংকের স্থায়ী আমানত হিসাব বা মূলধন বাজারের বিভিন্ন রকম শেয়ার, বন্ড ও ফান্ডে অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই জায়গাতেও সাধারণেরা বিনিয়োগ ভাবনার সঠিক সমাধান পাচ্ছেন না, কারণগুলো নিন্মরূপ—

প্রথমত, সরকার ব্যাংকের আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদের হার নির্ধারণের ফলে আমানত হিসাবে ব্যাংকগুলো এখন সাধারণত ৪ থেকে ৬ শতাংশ হারের মধ্যেই সুদ প্রদান করে যা সঞ্চয়পত্রের তুলনায় অনেক কম। একটু বেশি লাভের আশায় বিনিয়োগকারীরা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ছুটছেন কিন্তু বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা পাচ্ছেন না।

তাছাড়া, মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ শতাংশের চেয়েও বৃদ্ধি পাওয়ায় আমানত হিসাবে গচ্ছিত অর্থের প্রকৃত মূল্য আসল থেকেও কমে যাচ্ছে যা সত্যি একটি ভাবনার বিষয়। যদিও সরকার ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে যে, আমানতের সুদের হার কোনোক্রমেই মুদ্রাস্ফীতির হার-এর নিচে নির্ধারণ করা যাবে না তথাপি ব্যাংকগুলো এই নির্দেশনা খুব কমই মানছে।

দ্বিতীয়ত, মূলধন বাজারে ভিন্ন রকম শেয়ার, বন্ড ও ফান্ডে বিনিয়োগ অবস্থাও বর্ষাকালীন মেঘলা আকাশে সূর্যের আলোর ক্ষণিক ঝলকানির মতো। এক, দুই কিংবা সর্বোচ্চ তিনদিন কোনো শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর চতুর্থ দিন থেকে আবার কমতে শুরু করে। আর, এতেই ভিন্নরকম গুজবে আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি শুরু করে দেন এবং প্রত্যাশিত ভাবেই পুঁজিবাজারে ধস নেমে আসে।

ফলে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবারও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং অন্যদিকে বাজার কারসাজি চক্রের লোকেরা অল্প দামে ঐ শেয়ার কিনে এই অবস্থার পূর্ণ ফায়দা লুটে নেন।

এক দিকে যেমন মানুষের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ থেকে আয় খুবই নগণ্য, আবার অন্য দিকে পুঁজিবাজার বা বন্ড মার্কেটে তাদের বিনিয়োগ অভিজ্ঞতাও বেশ নেতিবাচক। তাহলে, তারা বিনিয়োগ করবেন কোথায়?
পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতন ঠেকাতে গত মার্চ মাসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জরুরি ভিত্তিতে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা ছাড় করে যা আইসিবি পুঁজিবাজারে ব্যবহার করবে।

এছাড়াও দরপতন ঠেকাতে শেয়ারের মূল্য পতনের নতুন সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই সীমা অনুযায়ী, কোনো শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কমানো যাবে এবং বাড়ানো যাবে ১০ শতাংশ।

এসব সিদ্ধান্তে সাময়িক লাভ হয়েছে ঠিকই কিন্তু, এখনো পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনা যায়নি। পুঁজিবাজারের অস্থিরতার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই বাজারেও বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না।

সঞ্চয়পত্রের বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে আজকাল স্বল্প সংখ্যক বিনিয়োগকারী ক্রিপ্টো কারেন্সি বা বিটকয়েন, স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা, জমি বা ফ্ল্যাটের মতো বিষয়ে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। তবে আইনি জটিলতা, সময়, অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব বিষয়ে অনেকের পক্ষেই বিনিয়োগ সম্ভব নয়।

এক দিকে যেমন মানুষের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ থেকে আয় খুবই নগণ্য, আবার অন্য দিকে পুঁজিবাজার বা বন্ড মার্কেটে তাদের বিনিয়োগ অভিজ্ঞতাও বেশ নেতিবাচক। তাহলে, তারা বিনিয়োগ করবেন কোথায়?

তাই, সরকারের উচিত হবে অল্প আয়ের মানুষদের জন্য আগামী বাজেটে সঞ্চয়ের নিরাপদ ও যৌক্তিক মুনাফা যোগ্য বিনিয়োগের সুযোগ রাখা। অন্যথায়, চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় পরিচালনা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়