• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ১২:৪১:৩৪
প্রকাশের সময় :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:৩৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:৩৯ অপরাহ্ন

২৪৬ বার দেখা হয়েছে ।

কল্লোলিত কণ্ঠস্বর তাঁর ভালোবাসার সাম্পান

কল্লোলিত কণ্ঠস্বর তাঁর ভালোবাসার সাম্পান

গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের সাহিত্য আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কোনো সমাজে যখন একটা পালাবদলের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন তা প্রথম ধরা পড়ে সেই সমাজের অনুভূতিপ্রবণ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মনোজগতে। তাঁরা ওই পরিবর্তনের ইঙ্গিত পান, ওই ব্যাপারে সজাগ হন এবং সেই অস্পষ্ট ইঙ্গিতকে নিজেদের শিল্প ও সাহিত্যকর্মের ভেতর নানাভাবে রূপ দেন। সেই রূপ কখনো মূর্ত, কখনো অস্পষ্ট, কখনো বিমূর্ত ও আপাত-অচেনা।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যের প্রধান ধারাটি আশাভঙ্গের বেদনা ছেড়ে নতুন সম্ভাবনায় চমকিত হয়ে জেগে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের সাহিত্য আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল ভাষা আন্দোলন এবং তার প্রেরণা থেকে জন্ম নেওয়া স্বকীয়তা ও স্বদেশ-অন্বেষণ। আর এর মধ্যে ছিল যুগ-যুগান্তের দেশজ ঐতিহ্য ও আবহমান বাঙালিত্বের চেতনা। পাকিস্তান-কাঠামোতে আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষণ যে অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল, সেই উপলব্ধি তখনকার অগ্রগণ্য লেখকদের রচনায় স্পষ্ট ছিল। জাতিসত্তার ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের উৎকণ্ঠা ও স্বপ্ন যতখানি ছিল, তার স্বরূপসন্ধানের সংগ্রাম ও পথনির্দেশ তখনো সুচিহ্নিত ছিল না ততখানি। পূর্ব বাংলার নিজস্ব স্বরে নির্মিত কবিতায়, নতুন ভূখণ্ডের কথাসাহিত্যে, মননদীপ্ত প্রবন্ধে বারবার ধ্বনিত হয়েছে মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ আর অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি উচ্চস্বর অঙ্গীকার। ভাষা আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া পঞ্চাশের দশকের সেই প্রেরণা বিচ্ছুরিত হয়েছে পরের দশক পর্যন্ত। প্রধান-অপ্রধান নানা সাহিত্য পত্রিকায় সেই নতুন ভাবনার স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ রয়েছে।

ষাটের দশকের শুরু থেকে নবীন কবি ও গদ্য লেখকরা পূর্বতনদের নির্ধারণ করা গন্তব্য, তাঁদের নির্মাণ করা পথ আর চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁদের আরাধ্য স্থিতাবস্থা সম্পূর্ণ বর্জন করেন। গন্তব্য নিয়ে তাঁরা বিচলিত ছিলেন না। নতুন, অজানা, অনিশ্চিত, ঝুঁকিবহুল ও কণ্টকিত পথ নির্মাণ আর যাত্রার আনন্দেই তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। এই দশকের শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত ছিল এমনই এক অনিশ্চিত আনন্দযাত্রার কোলাহলময় অবক্ষয়ের কাল। জাতীয় চেতনাসমৃদ্ধ ধারা থেকে অনেকখানি দূরে সরে গিয়ে ষাটের দশকের সাহিত্যিকরা নিমগ্ন হয়েছিলেন আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের অবক্ষয়ী মূল্যবোধে। বিচ্ছিন্নতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার রূপায়ণ, প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর শাণিত নিপুণ কলাকৈবল্যকে তাঁরা আরাধ্য হিসেবে নিয়েছিলেন।

তারপর সেই ষাটের দশকেই ক্রমান্বয়ে স্পষ্টতর হতে শুরু করেছে আমাদের জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। শুরু হয়েছে জাতীয় চেতনার স্পষ্টতর উন্মেষ। তার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে আমাদের চিন্তার জগতে, আমাদের কবিতায়, নাটকে ও প্রবন্ধে। সেই ধারা আমাদের পৌঁছে দিয়েছে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অবধি। বিশেষত কবিতা ও গদ্যভাষার নবনির্মাণ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনা, আমাদের ব্যক্তি ও জাতিগত সত্তার উন্মেষ, গঠনপ্রক্রিয়া ও বিকাশের সঙ্গে প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে ষাট ও সত্তরের দশকের সাহিত্য। অপরিমেয় প্রত্যাশা ও দুরন্ত প্রত্যয়ে চিহ্নিত সেই বছরগুলো একালের বহু মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছেদ রচনা করেছে। এই সময়কালের মধ্যেই আমাদের সাহিত্য অস্থির ও লক্ষ্যহীন উদভ্রান্তির পর্যায় পেরিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন প্রত্যাশার পথে। দেখা দিয়েছে নতুন দেশে সুস্থ-সংহত জীবনচেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠার অমিত সম্ভাবনা।

একদিকে স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকে আমাদের মনের ভেতরে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট রূপকল্প নির্মিত হতে শুরু করেছে, আর অন্যদিকে আমাদের জীবন ও চৈতন্য ক্রমশ আকৃতি লাভ করেছে এই ভূখণ্ডের মৌলিক ধারা ও নিজস্ব ভাষায় সৃজিত কবিতা ও গদ্যের ভেতরে। আমাদের সাহিত্যের এই ক্রমবিকাশের সূচনালগ্ন থেকেই অল্প কিছু সাময়িক পত্র ও বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন পালন করেছিল অবিস্মরণীয় ভূমিকা। এসব পত্রিকার পৃষ্ঠাকে অবলম্বন করেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল নিরীক্ষাধর্মী, পরিশ্রমসৃজিত, অমসৃণ ও সাহসী সংস্কৃতিচেতনা ও সাহিত্যভাষার অবয়ব। আমাদের মনীষার জগতের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা এই সময়ে শুধু নিজেদের রচনাভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে আবদ্ধ থাকেননি। তার বদলে সম্পাদক ও সাহিত্যকর্মী হিসেবে অপেক্ষাকৃত নবীন সাহিত্যিকদের ভালো লেখার জন্য প্রেরণা জুগিয়েছেন। এই সম্পাদকরা মেধাসাধ্য সম্পাদকীয় পরিশীলন দিয়ে, মুদ্রণজগতের তুচ্ছ ও শ্রমসাধ্য সব দৈনন্দিন কাজ সমাপন করে, সুরুচিশোভন পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁদের রচনা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন।

 

দুই.

kalerkanthoবাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে যে কটি লিটল ম্যাগাজিন তথা সাহিত্য সাময়িকীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে তার অন্যতম হলো ‘কণ্ঠস্বর’। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত এই সাহিত্য পত্রিকা প্রথমে মাসিক ও পরে ত্রৈমাসিক, কখনো নিয়মিত এবং মাঝেমধ্যে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার আকার, পৃষ্ঠাসংখ্যা, বিভিন্ন সংখ্যা প্রকাশের কাল-ব্যবধান, নিয়ম-অনিয়ম—সব কিছু তুচ্ছ করে এই পত্রিকা সাহিত্যের একটি নতুন ধারা ও উৎকর্ষের উচ্চতর মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই ধারার প্রায় একমাত্র অভিযাত্রী হিসেবে সাহসী পায়ে এগিয়ে চলেছে এবং তাকে স্রোতস্বতী রেখেছে দীর্ঘকাল। পুরো প্রকাশকালে আমাদের সাহিত্যে লেখক ও পাঠক তৈরিতে এর সামগ্রিক প্রভাব ছিল অপরিমেয়রূপে গভীর ও ব্যাপক।

যে লেখকদের এই সম্পাদক তাঁর পত্রিকার পৃষ্ঠায় একত্র করেছিলেন তাঁরা সবাই তখন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল ও নবীন লেখক, কবি ও সাহিত্যযাত্রী। কেউ কেউ নিজেদের প্রবন্ধের ভাষায় ও আঙ্গিকে শিল্পসচেতনতা ও নান্দনিক শুদ্ধতার দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন। কেউ কথাসাহিত্য ও কবিতায় করেছেন অবক্ষয়ের আরাধনা। কেউ দ্রোহে ও প্রাণচাঞ্চল্যে উচ্চকিত, কেউ কেউ শাণিত করে চলেছেন তাঁদের দৃষ্টি ও ভাষা। আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে আবদুল হাফিজ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা পর্যন্ত কত অসংখ্য প্রিয় লেখক তখন কণ্ঠস্বর পত্রিকার পৃষ্ঠা আলোকিত করেছেন তার হিসাব করা কঠিন। যাঁদের হাতে সাহিত্যের কালান্তর সৃষ্টি হয়ে চলেছে এ রকম দশ-পনেরোজন সাহিত্যিককে দিয়ে, তাঁদের শ্রেষ্ঠ লেখা লিখিয়ে নেওয়া আর অন্বিষ্টের পথে পদযাত্রায় তাঁদের একাগ্র ও জাগ্রত রাখার সবচেয়ে দুরূহ কাজটি সুচারুভাবে করেছেন সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর মনে হয়, কিভাবে তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে নবীন ও সবচেয়ে শাণিত লেখকগোষ্ঠীর শিল্পসচেতন, প্রকরণপ্রবণ ও মননশীল রচনা দিয়ে কল্লোলিত করে তোলা সাহিত্যধারার দিকে একটা বড়সংখ্যক পাঠককে আকর্ষণ করলেন। লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রকাশ যতই মনোযোগ দাবি করুক, একজন উচ্চমেধার পরিশ্রমী সম্পাদক তা পূরণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু সাহিত্যের একটি নতুন কাল পর্বে নতুন প্রবণতা ও নতুন নিরীক্ষার জন্য সহস্র পাঠককে আগ্রহী ও উন্মুখ করে তোলার কাজটা কত কঠিন তা আজও যেকোনো সম্পাদক ও প্রকাশক নিশ্চয়ই জানেন। একটি নতুন সাময়িকীর পক্ষে এই অগ্রগণ্য স্থান অর্জন করা সহজসাধ্য ছিল না। সম্পাদক হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এ দুইয়ের সমন্বয়সাধন।

পরিপাটি মুদ্রণ, সুচারু প্রুফ সংশোধন, উত্কৃষ্ট কাগজ নির্বাচন, কাঙ্ক্ষিত ও প্রিয় শিল্পীকে দিয়ে প্রচ্ছদ আঁকিয়ে নেওয়া—এসব জাগতিক কাজে সম্পাদক স্বয়ং কতটা সময় দিয়েছেন তার বিবরণ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দিয়েছেন তাঁর নিজের লেখা স্মৃতিকথনে, ‘ভালোবাসার সাম্পান’ নামক গ্রন্থে। তাঁর স্মৃতিকথায় আরো অনেক বিস্তারিতভাবে রয়েছে পত্রিকার ব্যয় সংকুলানের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কিভাবে একটু একটু করে তিনি সংগ্রহ করেছেন। সেই ষাটের দশকে আমাদের অর্থনীতির আকার ও বাণিজ্যজগতের আয়তন এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যে এ রকম একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য দরকারি টাকা বিজ্ঞাপন থেকে তুলে আনা যায়। সে কাজের দায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যকর্মী খুব বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারেননি। নিজে সেই অল্প টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য কিভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন, সেই গল্প সম্পাদক তাঁর স্মৃতিকথায় বিস্তারিত লিখেছেন। এই কাহিনি ছোট কাগজ বা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের জন্য প্রেরণা ও সান্ত্বনার উৎস হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেই সম্পাদক এত সব জাগতিক ও আর্থিক দায়দায়িত্ব পালন করেও তাঁর পত্রিকার জন্য সেকালের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি লিখিয়ে নিতে পেরেছেন। সৃষ্টি করতে পেরেছেন সাহিত্যযাত্রার উচ্চতর মান। তাঁর পরিশ্রমের প্রতিটি স্বেদবিন্দু সার্থক হয়েছে। এর জন্য যে অপরিসীম ত্যাগ তাঁকে করতে হয়েছে তা যেন আমরা ভুলে না যাই।

আজ কেউ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধ, জার্নাল, স্মৃতিকথা, গল্প ও বক্তৃতার সংগ্রহ পড়ে লেখক হিসেবে তাঁর সৃষ্টিশীল অসাধারণত্ব সহজেই টের পাবেন। রচনার উৎকর্ষ ও পরিমাণ বিস্ময়কর। অথচ তাঁর লেখালেখির সূচনার সময়টিতে যা হতে পারত নিজের লেখার সবচেয়ে স্বর্ণপ্রসূ কাল, তা তিনি ব্যয় করেছেন সমসাময়িক অথবা তরুণতর লেখকদের জন্য। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে তাঁদের উদ্দীপনা জুগিয়েছেন আরো ভালো লেখায় মনোযোগী হতে। নবীন লেখককে হাত ধরে তুলে নিয়েছেন তাঁর অলৌকিক জলযানে। এত প্রবল একটি সাহিত্যসংশ্লিষ্ট জীবন কাটিয়ে প্রথম দশ-পনেরো বছরে তিনি নিজের লেখার প্রতি মোটেই মনোযোগ দেননি। ‘দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’ নামের একটি প্রবন্ধ সংকলন আর শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস, কিছু কবিতা, ছোট প্রবন্ধ ও বই সমালোচনা ছাড়া বড় কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি তাঁর। নিজের জীবন ও নিজস্ব সাহিত্যকর্মের শত টান উপেক্ষা না করলে তিনি এত বড় কাজ করতে পারতেন না। একাগ্র হয়ে সমস্ত মনোযোগ তিনি দিয়েছেন পত্রিকার সম্পাদনায়। তাঁর জীবন-যৌবন সমর্পিত হয়েছিল নিজের পত্রিকার মধ্য দিয়ে সেকালের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল দলটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে।

“একজন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক শেষ পর্যন্ত একজন দলনেতাই। একটি সমবেত সাহিত্যযাত্রাকে তাঁর এগিয়ে নিতে হয়। তাই তাঁকে চলতে হয় দেখে-বুঝে, পা ফেলতে হয় হুঁশিয়ার হয়ে। সবার মান রেখে, মন রেখে, সবাইকে খুশিতে রেখে, তাদের নিয়ে তাঁকে অভীষ্ট জয় করতে হয়। চারপাশের প্রতিটি লেখকের আলাদা চাহিদা জোগান দিতে হয় তাঁর, আলাদা জিভের স্বাদ মেটাতে হয়। কাজটা সোজা নয়। এতগুলো ভিন্ন দেবতাকে তুষ্ট করা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে তারা যেখানে সবাই একেকজন দিগ্বিজয়ী তরুণ, মনের ভেতর প্রত্যেকেই জগতের শ্রেষ্ঠতম লেখক, অমরত্বের ব্যাপারে যাদের মনে সন্দেহের খড়কুটোও নেই। ” (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ভালোবাসার সাম্পান)। এর চেয়ে সরলভাবে, এর চেয়ে সংক্ষেপে সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেই পালাবদলের কাল পর্বে নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়ে সমন্বিত, সংহত ও বহমান করে রেখেছিলেন দীর্ঘ এক দশক ধরে। এই ভূখণ্ডের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা এও জানেন যে গত শতাব্দীর মধ্যষাট থেকে মধ্যসত্তর শুধু দশটি বছর নয়, এটা এক অভূতপূর্ব পালাবদলের কাল।

‘ভালোবাসার সাম্পান’ নামের এই স্মৃতিকথা পড়তে গিয়ে পাঠক শুধু একটি পত্রিকার আনুপূর্বিক ইতিহাস জানতে পারবেন, তা নয়; শুধু সেই বিশেষ কাল পর্বের দ্রোহী ও সোচ্চার লেখকদের কথা বা ওই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত লেখকগোষ্ঠীর সান্নিধ্যের অম্লমধুর গল্প পড়বেন তা-ও নয়; পাঠক একটা পালাবদলকে প্রত্যক্ষ করবেন। আলাদা আলাদা করে সে সময়ের সব প্রধান কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রবন্ধকারের চিন্তার পরিমণ্ডলকে ছুঁতে পারবেন। এমনকি ওই গোষ্ঠীর বাইরে দেশের অন্য ধারার পত্রপত্রিকা বা দেশের বাইরের, বিশেষত কলকাতার প্রধান কবি ও সম্পাদকদের চিন্তা ও কাজ সম্পর্কে ধারণা পাবেন। একজন সম্পাদকের দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ অবলোকনের চিহ্ন, তাঁর মনোজগৎ, যুগান্তর সৃষ্টি করা সাহিত্য আন্দোলন আর তাঁর বিচার-বিশ্লেষণ থেকে জন্ম নেওয়া সারবস্তু, সজীব গদ্যে সমকালীন সাহিত্যসঙ্গীদের অন্তরঙ্গ পরিচয়—এই সব দিক থেকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালোবাসার সাম্পান’ বইটির সঙ্গে তুলনীয় আর অল্প কয়েকটি মাত্র বই বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে। সাগরময় ঘোষের মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকার স্মৃতিকথা বাদ দিলে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে থাকবে দুটি মাত্র বই। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ আর বুদ্ধদেব বসুর ‘আমাদের কবিতাভবন’।

 

তিন.

বাংলাদেশের সাহিত্য সাময়িকীর ক্ষেত্রে তখনকার কালটি ছিল কল্লোলিত ও স্বর্ণপ্রসূ। কণ্ঠস্বর আত্মপ্রকাশ করার ঠিক আগে ছোট, স্বল্পায়ু ও সম্ভাবনাময় বেশ কিছু সংকলন প্রকাশিত হয়। অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে স্বাক্ষর, সপ্তক, কালবেলা ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিন। তারও আগে থেকে অপেক্ষাকৃত সংগঠিত উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে পূর্বমেঘ, উত্তরণ, পরিক্রম, উত্তর-অন্বেষা—এই কয়েকটি সুপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকা। আর সর্বোপরি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত মাসিক সমকাল সে সময় সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রায় অনতিক্রম্য উৎকর্ষ ও মর্যাদার আসনটি করায়ত্ত করতে পেরেছে। বিশেষত চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের সব প্রধান ও শক্তিমান লেখক জড়ো হয়েছিলেন রুচিস্নিগ্ধ ও আধুনিক এই মাসিক পত্রিকার উদার পৃষ্ঠায়।

এ রকম সৃষ্টিমুখর সময়ে নতুন একটি পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিয়েছিল, তার ব্যাখ্যা সম্পাদক নিজে বিভিন্ন সময় লিখেছেন। কখনো সে কথা সংক্ষেপে লিখেছেন কণ্ঠস্বর পত্রিকার উচ্চকণ্ঠ ঘোষণাপত্রে, কখনো লিখেছেন সুচিন্তিত ও পরিশীলিত সম্পাদকীয় রচনায়। আবার বহু বছর পর নিজেদের ভালোবাসার সাম্পান নিয়ে আনন্দ অভিযাত্রার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সে কথা লিখেছেন তাঁর নিজের বইয়ে বিস্তারিত পরিসরে।

নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও সাহিত্যযাত্রার প্রস্তুতি চলছিল কয়েক বছর ধরে। তারপর কণ্ঠস্বর পত্রিকার যুগটি সূচিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে এর প্রথম প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বুটের নিচে যে পত্রিকা জন্ম নিয়েছে, তা শুরু থেকেই জ্বালিয়েছে অবক্ষয়ের মশাল। শুধু সেই স্থবির সময়ের ক্লেদ আর অবক্ষয়কে ধারণ করেই থেমে থাকেনি কণ্ঠস্বর। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে যে অশান্ত কাল পর্ব শুরু হয় তা থেকে সঞ্চারিত দেশপ্রেমের উন্মাদনা ও অনুপ্রেরণাও কণ্ঠস্বরের পৃষ্ঠায় স্থান করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর নতুন দেশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধারণ করার জন্য বিস্তীর্ণতর আঙ্গিকে ও কলেবরে উন্মুখ হয়ে ছিল পত্রিকাটি। আর এই অনন্য স্রোতস্বিনী ধারাটির আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে এগারো বছরেরও বেশি সময় পরে, মধ্যসত্তরের দশকের মর্মান্তিক ও অস্থির সময় পার হয়ে ১৯৭৬ সালে।

স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ব ও পরবর্তী—এই দুটি দশকে সক্রিয় থাকলেও কণ্ঠস্বর ১৯৬০-এর দশকের মূল সুরটিকে ধারণ করতে পেরেছে বেশি স্বচ্ছন্দে। পরবর্তীকালে সত্তরের দশকের পরিবর্তিত সমাজ ও সময়ের ভাষাকে ধারণ করে নতুন যুগের নবীনতর অস্থিরতার সঙ্গেও সংলগ্ন থাকতে চেয়েছে এই সাময়িক পত্র। নবপর্যায়ের ত্রৈমাসিক কণ্ঠস্বরকে স্বাধীন দেশের প্রথম দশকের নবীন লেখকগোষ্ঠী আন্তরিকভাবেই নিজেদের পত্রিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে কণ্ঠস্বরের চরিত্র অধিকতর সংগতিপূর্ণ ছিল প্রধানত ষাটের দশকের তরুণ ও নবীন সাহিত্যকর্মীদের দৃষ্টি, ভাবনা ও চেতনার সঙ্গে। গত শতাব্দীর ওই দশকের তরুণ সাহিত্যিকরা তাঁদের অব্যবহিত পূর্বকালটির প্রচল ও প্রথার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সাহিত্যধারা নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। আমাদের সাহিত্যে ষাটের দশকের প্রথমার্ধের অবক্ষয়ের ধারাটি মূলত এ দেশের সামাজিক অবরুদ্ধতা, অপশাসন ও নিষ্পেষণ থেকে উত্থিত হলেও আমেরিকার বিটনিক সাহিত্য ও পশ্চিমবঙ্গের কৃত্তিবাসের ধারা এর ভেতরে বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। এ সময়ের কবি ও কথাসাহিত্যিকরা তাঁদের দেশজ পূর্বসূরিদের তুলনায় অধিকতর আকৃষ্ট হয়েছেন পশ্চিমের প্রতি। প্রভাবিত হয়েছেন পশ্চিমের কিছুসংখ্যক কবি ও শিল্পীর জীবন, সাহিত্যভাবনা ও সৃষ্টির দ্বারা। তাঁরা অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেছেন পশ্চিমা সাহিত্য ও শিল্পকলার নতুন প্রবণতা ও শিল্প আন্দোলন থেকে। এ ছাড়া এই সময়ে নতুন এক গদ্যভাষার চর্চা শুরু হয়েছিল, যা পূর্ববর্তীকালের গদ্যরীতির তুলনায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অনেক বেশি অর্থবহ ও চমকপ্রদ।

এই নতুন কাল পর্বের দ্রোহ, আত্মমগ্নতা, মৌলিকত্ব, সৃজনশীলতা ও নিরীক্ষাধর্মিতাকে অবাধে ধারণ করেছে কণ্ঠস্বরের পৃষ্ঠা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বর তার ধারণক্ষমতার ব্যাপ্তি ও গভীরতায়, অনুসন্ধান ও নিরীক্ষণশীলতায়, অকপট ও শাণিত সমালোচনায় এবং সাহসী সম্পাদকীয় প্রত্যয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সর্বাধিক ব্যাপকভাবে সমকালীন সাহিত্য ও সাহিত্যকর্মীদের প্রাণিত করতে পেরেছে। বিভিন্ন সময়ে কণ্ঠস্বরে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ঘোষণাপত্র ছিল সমকালের তুলনায় স্বতন্ত্র, সুতীক্ষ ও উচ্চকণ্ঠ। এ রকম দুটি উদাহরণ : ১. যারা সাহিত্যের সনিষ্ঠ প্রেমিক, যারা শিল্পে উন্মোচিত, সৎ, অকপট, রক্তাক্ত, শব্দতাড়িত যন্ত্রণাকাতর, যারা অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী, যারা তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত, যারা পঙ্গু, অহংকারী, যৌনতাস্পৃষ্ট, ‘কণ্ঠস্বর’ তাদেরই পত্রিকা। প্রবীণ মোড়ল, নবীন অধ্যাপক, পেশাদার লেখক, মূর্খ সাংবাদিক, পবিত্র সাহিত্যিক ও গৃহপালিত সমালোচক এই পত্রিকায় অনাহূত। (কণ্ঠস্বর, প্রথম সংকলন, জানুয়ারি ১৯৬৫)

২. সাহিত্যকে যাঁরা অনুভব করতে চান শততলে, শতপথে, বিঘ্নিত রাস্তায়; আঙ্গিকের জটিলাক্ষরে, চিন্তার বিচিত্র সরণিতে; কটু স্বাদে ও লোনা আঘ্রাণে; সততায়, শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে অভিভূতিতে ও পাপে; মহত্ত্বে ও রিরংসায়, উৎকণ্ঠায় ও আলিঙ্গনে, কণ্ঠস্বর সেসব পদপাতবিরল তরুণদের পত্রিকা। (কণ্ঠস্বর, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ১৯৬৭)

ষাটের দশকের সাহিত্যধারাটির মূল চরিত্র-লক্ষণগুলো কণ্ঠস্বরের পৃষ্ঠাকে আশ্রয় করেই সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছিল। এই লক্ষণগুলো ওই সময়ের আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা, তাদের শিল্পগুণ, তাদের বক্তব্য, ভাষা ও ভঙ্গি থেকে অনেকখানি আলাদা। এর মৌলিক চরিত্রের মধ্যে ছিল বিচ্ছিন্নতা ও অবক্ষয়ের আরাধনা, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের জাগরণের পাশাপাশি অনিকেত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, দ্রোহী অথচ আত্মমগ্ন দৃষ্টিভঙ্গি, কবিতার নতুন স্বর, প্রবন্ধের মননদীপ্র গদ্য আর সর্বোপরি সব ক্ষেত্রে নান্দনিক শুদ্ধতার অন্বেষণ।

 

চার.

পত্রিকা প্রকাশের প্রথম ছয় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও বিপুল স্বপ্ন ও সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। নৈরাশ্য ও অর্থহীনতার আবর্ত থেকে সরিয়ে এনে ইতিবাচক জীবনাগ্রহে এই নতুন দেশের সাহিত্যকে গড়ে তোলার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য নতুন উদ্দীপনায়, নবীন আবেগে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় কণ্ঠস্বর। ১৯৭২ সালে সম্পাদকীয় ঘোষণায় কণ্ঠস্বর সম্পাদক সাহিত্য-সততার উচ্চতর আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং সদ্যঃস্বাধীন দেশের সার্বিক উজ্জীবনের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রত্যাশা ছিল, এই নতুন সময়ের সাহিত্যে শিল্পের সঙ্গে প্রজ্ঞা, নতুনত্বের সঙ্গে উদ্দেশ্য ও মৌলিকতার সঙ্গে জীবনোন্মুখতাকে গ্রথিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রথম সত্তরের সার্বিক উজ্জীবন দীর্ঘজীবী হয়নি। তৎকালীন প্রধান লেখকগোষ্ঠীর আত্মমগ্নতা, কলাকৌশলপ্রবণতা, অন্তর্গত বৈপরীত্য, দেশ গঠনের অগ্রাধিকার থেকে বিচ্ছিন্নতার বোধ, সাহিত্য-সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কারণে কণ্ঠস্বরের এই গঠনমুখী অঙ্গীকার জাতির অন্যান্য স্বপ্নের মতোই অপূর্ণ থেকে গেছে।

মূলত ছোট কাগজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ হলেও রচনাগুলোর তুলনামূলক উৎকর্ষ, লেখকদের দ্রুত স্বীকৃতি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার উচ্চ মান এবং সমকালীন সাহিত্যে এসবের পরিব্যাপ্ত প্রভাব—এই সব মিলে কণ্ঠস্বর অচিরেই ওই কাল পর্বের প্রধান সাহিত্য সাময়িকী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। প্রথম কয়েক বছর পত্রিকাটির আকার বদলেছে, কিন্তু আয়তন থেকেছে ছোট। মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ পৃষ্ঠার (কখনো কখনো আরো কম, এমনকি মাত্র ১৬ পৃষ্ঠার) ক্ষীণকায় একটি পত্রিকা বিস্ময়কর আগ্রহ জাগিয়েছে ওই সময়ের তরুণ সাহিত্যপাঠকের মনে। এই সীমিত পৃষ্ঠার পরিসরেই প্রকাশিত হয়েছে বহু আলোচিত ও সাড়া জাগানো রচনা। এর ভেতর থেকেই উঠে এসেছেন আজকের অনেক খ্যাতিমান কবি ও গদ্য লেখক।

সত্তরের দশকে পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি সত্ত্বেও সম্পাদকের উন্নত সাহিত্যনিষ্ঠা ও মানদণ্ড, প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে দূরে থাকার আকাঙ্ক্ষা এবং ক্রমাগত নবীন লেখকদের স্বাগত জানানোর সময়োপযোগী ঔদার্যের ফলে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রটি দীর্ঘদিন অক্ষুণ্ন রাখে কণ্ঠস্বর। ক্রমান্বয়ে এই পত্রিকার সূচনালগ্নের বেশির ভাগ লেখক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মূলধারার প্রধান প্রধান কবি, গবেষক, সমালোচক ও অধ্যাপক। যেসব কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ ও অন্যান্য রচনার জন্য পরিণত বয়সেও এই লেখকদের প্রধান পরিচয় ও খ্যাতি সেসবের বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের নবীন ও প্রতিবাদী বয়সে, কণ্ঠস্বর পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায়। এঁদের অনেকেরই পরিচয় ছিল কণ্ঠস্বরের লেখক হিসেবে। এ রকম রচনা ও লেখকদের তালিকা দীর্ঘ; তাঁদের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা প্রশ্নাতীত।

প্রকাশনার অন্তিম পর্যায়ে পত্রিকার পাঠক ও অনুরাগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, প্রকাশনামানের উৎকর্ষ ও সম্পাদকীয় আভিজাত্য স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাড়েনি অনাস্বাদিতপূর্ব নতুন ও বিতর্কযোগ্য রচনার সংখ্যা। লক্ষ করা যায়নি সম্পূর্ণ নতুন কিন্তু অসামান্য প্রতিভাবান, সম্পাদকের আরাধ্য সেই সব ‘পদপাতবিরল’ তরুণ লেখকের আগমন বার্তা। সুতরাং এই পর্যায়ে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের অনিবার্য সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে রচিত হলো কণ্ঠস্বর যুগের আনুষ্ঠানিক অবসান। এই সময়োচিত সিদ্ধান্ত কণ্ঠস্বরের সম্পাদকীয় বিচক্ষণতার আরেকটি উদাহরণ হয়ে রইল।

 

পাঁচ.

এই কালপরিধিতে কী বিশেষ অবদান রেখেছে কণ্ঠস্বর? এর উত্তরে বলা যায়, ষাটের দশক ও প্রথম সত্তরের সাহিত্যের মূল প্রবণতাটিকে সবচেয়ে ব্যাপক ও সুচারুভাবে তুলে ধরেছিল কণ্ঠস্বর। এ সময় কণ্ঠস্বরের নেতৃত্বে সমসাময়িক আরো কিছু লিটল ম্যাগাজিনের ধারাবাহিকতায় প্রধানত পুষ্টিলাভ করেছে আমাদের কবিতা ও প্রবন্ধ। কবিতার ক্ষেত্রে আরো অনেক ছোট পত্রিকা ব্যাপক ও ধারাবাহিক ভূমিকা রাখলেও মূলত কণ্ঠস্বর পত্রিকাই শ্রমসাধ্য, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার প্রবন্ধ-সাহিত্যকে মর্যাদার সঙ্গে আসন দিয়েছে। এই পথ ধরে কণ্ঠস্বরের সম্পাদকীয় ঘোষণাপত্রের মতোই প্রবন্ধ-সাহিত্যে অনন্য এক গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমরা বিশেষভাবে লক্ষ করি, অপ্রচলিত শব্দের উজ্জ্বল ব্যবহার, পরিচিত শব্দের নতুন প্রয়োগে চমকপ্রদ বিশেষণ, অভিনব ব্যঞ্জনা ও চিত্ররূপ তৈরি, সম্পূর্ণ নতুন বাক্যরীতি নির্মাণ, ব্যবহারজীর্ণ শব্দ ও বাকভঙ্গিকে সম্পূর্ণ পরিহার করে নিজস্ব ভাষা ও সজীব অভিব্যক্তি নির্মাণ। মূল্যবান সারবস্তুর সঙ্গে এসব গুণের পরিশ্রমী সমন্বয়ে অর্জিত হয়েছে প্রবন্ধের ভাষার অমসৃণ গতিপথ ও শিল্পসম্মত পরিশীলন।

ওই সময়ের কণ্ঠস্বর এবং সহগামী অন্য কয়েকটি পত্রিকায় প্রবন্ধের এই নিরীক্ষাধর্মী ভাষা সম্পর্কে প্রথাগত ধারার লেখক-পাঠকের নানারূপ অভিযোগকে তুচ্ছ করে দেয় কোনো কোনো বিশিষ্টজনের উদার প্রশংসা। কিছু কিছু সমালোচনাকে প্রশংসায় রূপান্তর করেন মুনীর চৌধুরী :

‘ব্যাকরণের দুরূহতম নিয়মকে বাক্য গঠনের মধ্যে টেনে নিয়ে ওরা এমন চমৎকার বাক্য গঠন করেছে যা আমার স্তিমিত চেতনাকে আঘাত করে নতুন অর্থ অনুসন্ধানের জন্য আমাকে প্রলুব্ধ করে। ’ (মুনীর চৌধুরী : আলোচনাসভা, ২৯ জুন ১৯৭০)

এর বিপরীতে স্মরণ করা যায় আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি প্রবন্ধ সম্পর্কে বশীর আলেহলালের তুমুল বিতর্ক ও বাদানুবাদ সৃষ্টি করা আলোচনা। ‘কণ্টকিত’ গদ্যপ্রবণতা সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করে ওই রচনায় বশীর আলেহলাল (মৃগীরোগের নান্দীপাঠ) সহজ ভাষারীতি বা ‘স্বাভাবিক গদ্যের চর্চা’ অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমাদের প্রবন্ধভাষার ক্ষেত্রে এটি একটি বহুল আলোচিত বিতর্ক। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ অন্যদের মননশীল আলোচনা নবীনতর গদ্য লেখকের জন্য চিন্তার উপকরণ ও দিকনির্দেশনা হয়ে রয়েছে।

যা-ই হোক, প্রধানত কণ্ঠস্বরের পৃষ্ঠাকে আশ্রয় করে দশ বছর ধরে জন্ম নিয়েছিল এই নতুন ও স্বতন্ত্র গদ্যরীতি, যা পরবর্তীকালের তরুণ গদ্য লেখকের অনিবার্য ভাষা। ১৯৭৫ সালে কণ্ঠস্বর পত্রিকার দশকপূর্তি উৎসব উপলক্ষে ফজল মাহমুদ ও ইফতেখারুল ইসলামের যৌথ সম্পাদনায় একটি ক্ষীণকায় স্মারক সংকলন প্রকাশিত হয়। সেখানে ‘আত্মপক্ষ’ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা লেখেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর প্রতিটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য হলেও অল্প কিছু কথা এখানে উদ্ধার করা হলো।

…কণ্ঠস্বর মূলত লেখক সৃষ্টির পত্রিকা। এ কারণেই কণ্ঠস্বর ‘স্থৈর্য ও সংযম’-এর নয়—নতুনত্ব এবং প্রতিভার; গৃহপালিত প্রাতিষ্ঠানিকতার নয়, প্রতিষ্ঠাহীন অনিকেতের; তারুণ্যের এবং ভুলের, শক্তির এবং অসহায়তার, সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাচার ও দুঃসাহসী মৌলিকতার—অগতানুগতিকতার, আপোষহীনতার, ব্যতিক্রমের। …নান্দনিক পরিশীলনের পাশাপাশি প্রতিভার উজ্জ্বল স্বেচ্ছাচারকে, কণ্ঠস্বর আজ অব্দি, একইভাবে অন্বেষণ করে।

…আমাদের চারপাশে আজ এক নবজাগ্রত দেশ এবং জাতি উন্মুখভাবে তার মৌলিক ভিত্তি অন্বেষণ করছে। রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা শিক্ষার মতো জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে এই ভিত্তি অন্বেষণের কর্মঠ শ্রম সোচ্চার। এই জাতির আদিমতম প্রজন্ম হিশেবে আমাদেরও আজ আমাদের জাতীয় সাহিত্যের সুদৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে যেতে হবে—আমাদের সাধনা, প্রতিভা, সততা এবং শ্রমের মূল্যে। আর এই সুদৃঢ় সুশৃঙ্খল চারিত্র্যশক্তির যোগ্যতাই আমাদের আগামী সাহিত্যের নেতৃত্বে নিতে পারে শুধু। (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, উত্তরপ্রজন্ম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯)

এই উন্মুখ অন্বেষণ আজও নবীন লেখক ও সম্পাদকের অনুপ্রেরণার উৎস। এটি সম্পাদক হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিপুল অর্জন। আমাদের সাহিত্যে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। স্বাধীনতাপূর্ব ও তার অব্যবহিত পরে আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অনন্যসাধারণ ও ঐতিহাসিক কাল পর্বে সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সমাজে বেশিসংখ্যক উচ্চায়ত মানুষ তৈরির জন্য তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ও আত্মনিবেদন শুরু হয়েছিল একটি উন্নত পত্রিকা সম্পাদনার কাজ দিয়ে।

সেই কাজ সার্থকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেও তিনি দেখেছেন তাঁর কিছু স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে। আগের মতোই, তিনি আবার তাঁর দূরাভিসারী জীবনস্বপ্ন দ্বারা চালিত হয়েছেন। আরো বড় সার্থকতার অন্বেষণ করেছেন অন্য স্বপ্নে, অন্য সংগঠনে, অনন্য ভূমিকায়। জ্ঞানচর্চার প্রতি আমন্ত্রণ যে আনন্দময় ও চিত্তাকর্ষক হতে পারে—তিনি না থাকলে এ কথা আমাদের অজানা থাকত। তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছেন সেই কাজে। আর কণ্ঠস্বর স্মরণীয় হয়ে রয়েছে দুটি কল্লোলিত সৃষ্টিশীল দশকের প্রধান সাহিত্যিক প্রবণতা এবং প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে প্রবাহিত বাংলা সাহিত্যের শত স্রোত ও অজস্র ধারার ভেতরে।