• ঢাকা
  • শনিবার:২০২৪:এপ্রিল || ০১:০৩:৩৩
প্রকাশের সময় :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:০৮ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
জুন ১৫, ২০২২,
১০:০৮ অপরাহ্ন

২৪২ বার দেখা হয়েছে ।

প্রাচীন ঢাকা খুঁজে ফেরা

প্রাচীন ঢাকা খুঁজে ফেরা

 

গবেষণার দুর্বলতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন নগরী ঢাকা অনেক দিন আটকে ছিল ৪০০ বছরের গণ্ডিতে। আমাদের বেশির ভাগ ইতিহাস গবেষণার গণ্ডি ঔপনিবেশিক যুগের ভেতরই আটকে ছিল অনেক দিন। তাই এ দেশের ঐতিহ্য-ভাবনা হয়ে পড়েছে অস্পষ্ট। এ কারণে ঢাকার ইতিহাস নিয়ে শিকড়সন্ধানী গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারায় সাতপুরাণ ধারণা থেকেই মনে করা হতো সতেরো শতকের শুরুতে মোগলদের পূর্ব বাংলা দখল ও ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী স্থাপনের মধ্য দিয়েই ঢাকার নাগরিক জীবনের শুরু।

আর এই খণ্ডিত ধারণা থেকে মানুষকে ইতিহাস বিভ্রান্ত করে সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে যে ঢাকা নগরীর প্রাচীনত্ব ৪০০ বছর মাত্র। সাম্প্রতিক ইতিহাস গবেষণা এ ধারণাকে পরিত্যাজ্য বিবেচনা করে নতুনভাবে ঢাকা অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছে। গবেষণার ফলাফল হিসেবে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে যে মোগলপূর্ব যুগেও ঢাকার নাগরিক জীবনের সরব উপস্থিতি ছিল। বর্তমান আলোচনায় এর একটি প্রাথমিক ছবি উপস্থাপন করা হলো।

মাটির দুর্গ

বাংলাদেশের প্রাচীন যুগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কারণে মাটির বা ইটের দুর্গ নির্মাণ করা হতো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় মৌর্য রাজাদের প্রদেশ পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী পুণ্ড্রনগর ছিল ইটের দেয়ালে ঘেরা নগরী। আজকের বগুড়ার মহাস্থানগড়ই ছিল সে যুগের পুণ্ড্রনগর। পুণ্ড্রনগরের সমসাময়িককালে বাণিজ্যনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বরে। এই নগরীটিও একসময় মাটির দুর্গে ঘেরা ছিল। এসব বড় উদাহরণ ছাড়াও ছোট ছোট অঞ্চলে দুর্গ গড়ার কথা জানা যায়। দুর্গ ঘেরা কোনো স্থান বা অঞ্চল অনেক সময় কোট বা গড় নামে পরিচিত। সাধারণত নদীপথের ধারেই কোট বা গড়ের অবস্থান ছিল। কোটবাড়ী নাম এই ধারণার প্রমাণ বহন করে। এই কোট বা গড়গুলো সাধারণত দুর্গ ঘেরা হতো। এখানে থাকত সেনাছাউনি, খাজনা আদায়কারী কর্মকর্তার অফিস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।

ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রাচীনকালে এমন অন্তত তিনটি দুর্গ অবস্থিত থাকার কথা জানা যায়। মিরপুর ও গাবতলীর মাঝামাঝি এমন একটি দুর্গের অস্তিত্ব ছিল বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় অনুমান করা হচ্ছে। এই এলাকার ভেতরে তিনটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে কোটবাড়ী, দিয়াবাড়ী ও দরিয়াঘাট। এই নামগুলো সুলতানি যুগের পূর্ব সময়ের বলে মনে করা হয়। কারণ সুলতানি যুগপর্ব থেকে পরবর্তী সময়ে এখানে কোটবাড়ী ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামো থাকার মতো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কোটবাড়ী জায়গাটি বর্তমানে গাবতলীর পর্বতা সিনেমা হলের পেছনের দিকে তুরাগ নদের তীরে অবস্থিত। প্রাচীন বাংলায় তুরাগ নদ অনেক প্রশস্ত ছিল। নদের উত্তর সীমায় ছিল সাভারের বিরুলিয়া আর দক্ষিণে ছিল মিরপুরের উঁচু ভূমি। দরিয়াঘাট নামকরণে নদের বিশালতার একটি ভূমিকা থাকতে পারে। কোটবাড়ী নামের ব্যবহার মুসলিমপূর্ব যুগ অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে অনুমান করা যায়, কৌশলগত কারণে তুরাগ নদের এই তীরাঞ্চলে দুর্গ সুরক্ষিত শুল্ক আদায়ের একটি প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপিত হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে কোটগুলো নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হতো। নদীর দিকটি খোলা রেখে বাকি তিন দিকে দেওয়া হতো মাটির উঁচু বেষ্টনী দেয়াল।

মাটি কাটার কারণে মিরপুরের কোটবাড়ীর তিন পাশেই ছিল গভীর পরিখা। কিছুকাল আগেও এই নিচু ভূমির অস্তিত্ব দৃশ্যমান ছিল। কয়েকটি স্থানের নাম আমাদের ধারণাকে আরেকটু স্বচ্ছ করে। কোটবাড়ীর কয়েক কিলোমিটার পূর্ব দিকে প্রথমে পাইকপাড়া এবং আরো পূর্ব দিকে সেনপাড়া পর্বতা বলে একটি স্থান রয়েছে। হিন্দু শাসন যুগে লাঠিয়াল যোদ্ধাদের পাইক বলা হতো। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল হিন্দু পাইক বাহিনী। পাইকপাড়া সম্ভবত সেনাবাহিনীর ব্যারাকের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। তবে এই নাম মুসলিম যুগ না হিন্দু যুগের স্মৃতি বহন করছে তা বলা মুশকিল। তবে সুলতানি বা মোগল যুগে ঢাকার এই অংশে মুসলিম প্রশাসন বিস্তৃত হয়েছিল তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য মুসলিম প্রশাসন না থাকলেও মুসলিম বসতিহীন ছিল না। কারণ পনেরো শতকে এখানে সুফি শাহ আলী বোগদাদী খানকাহ স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। শিলালিপি প্রমাণে তা নিশ্চিত করা যায়। মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে সুফির সমাধি রয়েছে। এই হিসেবে পাইকপাড়ায় যদি সেন বংশের শাসনকালে সেনাছাউনি গড়ে ওঠে তাহলে বেসামরিক সেন বংশীয়দের বসতি অঞ্চল হিসেবে দুই-আড়াই মাইল দূরে লাল মাটির উঁচু ভূমি অঞ্চলে সেনপাড়া পর্বতা নাম থাকাটা অযৌক্তিক নয় বলে ইতিহাসের যুক্তিতে বলা যেতে পারে। অবশ্য আরো গবেষণার পথ ধরেই নিশ্চিত হতে হবে। এ জন্যই শেষ মন্তব্য করার মতো সময় এখনো আসেনি বলে আমরা মনে করি। তবু কোটবাড়ী, পাইকপাড়া, সেনপাড়া স্থান নামের কারণে ও প্রাকৃতিক অবস্থানগত দিক পর্যবেক্ষণে অনুমান করা যায় সেন শাসনকালে অর্থাৎ এগারো শতকের শেষার্ধ বা বারো শতকে আজকের ঢাকার এই শহরতলিতে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।

একসময় ঢাকা গবেষণায় গবেষকদের খোঁজে যথেষ্ট তথ্য সূত্র ছিল না। তাই মোগলপূর্ব যুগে ঢাকা নগরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তবে দুই দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্র উন্মোচিত হওয়ায় এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস চর্চার বদ্ধ দরোজা একটু একটু খুলে যাওয়ায় নতুন বিশ্লেষণ ও নতুন তথ্য বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস লেখার পথ করে দিচ্ছে। এ কারণে ঢাকা নগরী নিয়ে নতুন কথা বলার পথও প্রশস্ত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার সময়কালেও ঢাকা যে একটি সমৃদ্ধ জনবসতি এবং বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সে সত্য ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে সেন শাসন যুগে বিক্রমপুর যখন রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল, তখন ঢাকার কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল সোনারগাঁ। সোনারগাঁ কেন্দ্রের অবস্থান শীতলক্ষ্যা নদীর আনুমানিক আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে। কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায়, সেন আমলে অর্থাৎ মুসলিম শাসকদের আগমনের আগেই বাণিজ্যনগরী হিসেবে ঢাকা নিজ অবস্থান তৈরি করেছিল। বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট করার জন্য হাকিম হাবীবুর রহমানের উর্দু ভাষায় লেখা ‘ঢাকা পচস বরস পহেলে’ গ্রন্থের দিতে তাকাতে হয়। তিনি লিখেছেন, বিক্রমপুর যখন সেন রাজাদের রাজধানী তখন বিক্রমপুরের কাছাকাছি এই ঢাকার দক্ষিণাংশে হিন্দু বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই যুগের স্মৃতিবিজড়িত নামগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতীবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলী, কুমারটুলী ইত্যাদি। এই নামগুলো মোগলপূর্ব যুগে হিন্দু নিয়ন্ত্রিত নানা পেশাজীবীর অবস্থান নিশ্চিত করছে। রাজধানী সোনারগাঁর নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অংশে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁ থেকে ঢাকায় নদীপথের যোগাযোগ থাকায় নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয়।

বখতিয়ার খলজির হাতে নদীয়া পতনের আগে সোনারগাঁ ছিল সেনদের অন্যতম শাসনকেন্দ্র। নদীয়া পতনের পর লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং বিক্রমপুরের শাসনভার গ্রহণ করেন। সোনারগাঁ তখন বিক্রমপুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা অনুযায়ী ১২৬০ খ্রিস্টাব্দেও বঙ্গ লক্ষ্মণ সেনের উত্তরসূরিদের শাসনাধীনে ছিল। তবে তবকাত-ই-নাসিরীতে সোনারগাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর এক শতক পর্যন্ত সোনারগাঁ থেকে কোনো মুদ্রা জারির প্রমাণ নেই। মুহম্মদ বিন তুঘলকের (১৩২৫-৫১ খ্রি.) রাজত্বকালেই সোনারগাঁ সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্যযুগের শুরু থেকে সোনারগাঁ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র। সুলতানি যুগে একটি শহরের অবস্থানকে নিশ্চিত করতে মুদ্রার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের মুদ্রার ইতিহাসে বাংলার বিশেষ মর্যাদা এ জন্য যে মধ্যযুগে এখানে একটি জাতীয় মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এ যুগে শুধু সরকারব্যবস্থা পরিচালনার কেন্দ্রগুলো থেকেই মুদ্রা জারি করা হতো না—ছোটখাটো শহরেও টাঁকশালের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুলতানি যুগ অবসানের পর বারোভুঁইয়াদেরও অন্যতম শাসনকেন্দ্র ছিল সোনারগাঁ। ঈশা খাঁ ও তাঁর পুত্র মুসা খাঁ শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে। বারোভুঁইয়াদের দমন করার জন্যই ইসলাম খাঁকে ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপন করতে হয়। শীতলক্ষ্যার পূর্বাঞ্চলে যে শক্তির উৎসভূমি তাকে কাছে থেকে মোকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান স্বাভাবিকভাবেই নদীর পশ্চিমাঞ্চলকে নিজ অবস্থান হিসেবে বেছে নেন। সে কারণেই বারোভুঁইয়াদের সঙ্গে ইসলাম খাঁর শেষ নৌযুদ্ধ হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।

মুসলিম বসতি

সুলতানি যুগে ঢাকার দক্ষিণাংশে আজকের পুরান ঢাকায় বাণিজ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে বলা যায়, উল্লেখযোগ্য শহরতলি হিসেবে ঢাকার উত্তরাঞ্চলেও সুলতানি যুগে গড়ে উঠেছিল মুসলিম বসতি। মিরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর (রা.) সমাধিসংলগ্ন একটি সুলতানি মসজিদ এর প্রমাণ। যদিও আধুনিকায়নের দাপটে বর্তমানে তা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। বাংলায় মোগল ইতিহাসের অন্যতম আকর গ্রন্থ মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’। ইসলাম খানের সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি নাথান উল্লেখ করেছেন মোগলরা ঢাকায় আসার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ অবস্থিত ছিল। এটি সংস্কার করে ইসলাম খানের বাসস্থান বানানো হয়। দুর্গটি সম্ভবত আফগান শাসন যুগে নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ সুলতানি যুগে ইকলিম মুবারকাবাদের রাজধানী ঢাকা বারোভুঁইয়াদের শাসনকালেও নিজ গৌরব ধরে রাখতে এবং নগরীর বিস্তার ঘটাতে পেরেছিল।

বাংলায় বহিরাগত মুসলমান সুলতানদের শাসনের শুরু হয় তেরো শতকের সূচনায়। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির মধ্য দিয়ে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিজয়ের সূচনা ঘটে। বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয় সম্পন্ন করেননি সূচনা করেছিলেন মাত্র। এরপর শতাধিক বছর ধরে দিল্লির মুসলিম সুলতানদের পাঠানো সেনাপতি ও গভর্নররা একটু একটু করে বাংলায় মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটাতে থাকেন। চৌদ্দ শতকের প্রথম পর্বেই বাংলার তিন অংশে তিনটি মুসলিম শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফারসি ভাষায় এই শাসনকেন্দ্র বা প্রদেশকে বলা হতো ইকলিম। এগুলো হচ্ছে উত্তর বাংলায় ইকলিম লখনউ, পশ্চিম বাংলায় ইকলিম সাতগাঁও এবং পূর্ব বাংলায় ইকলিম সোনারগাঁ।

১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁয় স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এই স্বাধীনতার সূত্র ধরেই শুরু হয়ে যায় দুই শত বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সালতানাতের যাত্রা। এই সময়কাল থেকে একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়।

সতেরো শতকের শুরুতে ঢাকায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠার আগে এ যুগের আকর গ্রন্থ ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’তে মির্জা নাথান প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতায় ঢাকার যে অবস্থার বর্ণনা করেছেন তা অনেকটা এমন—শহরটি প্রতিষ্ঠিত ছিল বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে। বর্তমান বাবুবাজারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে কয়েক মাইল পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল এই শহরটি।

পুরান ঢাকার অনেক স্থান-নাম হিন্দু নামে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। অনুমান করা হয়, এখানে প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু বসতি এবং তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। ঢাকা রাজধানী সোনারগাঁর নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁ থেকে ঢাকার নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয় নদীপথের যোগাযোগ থাকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা নির্ধারণ করে যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা ও দোলাইখাল (একদা দোলাই নদী)। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে প্রাক-মোগল ঢাকার পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন। ঢাকা দুর্গ

১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ বারোভুঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার অঞ্চলে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ ছিল। দুর্গের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ঘাটটির নাম ছিল চণ্ডীঘাট। বাহারিস্তান-ই-গাইবীর বক্তব্য অনুযায়ী এই অংশে তখন দুটি অঞ্চলের বিকাশ ঘটে। এই চণ্ডীঘাটটিই পরে চকবাজার নামে পরিচিত হয়। দুর্গ থেকে চণ্ডীঘাট পর্যন্ত বাজারের বিস্তার ছিল। ঢাকা নগরীর বিস্তারের যুগে ইসলাম খান (১৬০৮-১৩ খ্রি.) এখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নাম অনুসরণে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। এক শতকের চেয়ে সামান্য বেশি সময় ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় প্রশাসনিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিকাশ অব্যাহত থাকে।

মোগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রশাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা হয় মোগল সুবার রাজধানী। এর আগে সুলতানি শাসনযুগে এবং বারোভুঁইয়াদের আমলে সোনারগাঁ ছিল শাসনকেন্দ্র। এ কারণে ১৬১০-এর আগে ঢাকায় কোনো নাগরিক জীবন ছিল কি না এ বিষয়ে অনেক গবেষকই সন্দিহান ছিলেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপন না করে কেউ কেউ মোগলপূর্ব যুগে ঢাকায় একটি নগর নয়, জনপদের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রত্নসূত্র বিশ্লেষণ ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে। শিলালিপি সাক্ষ্য নিশ্চিত করছে ঢাকার কোনো কোনো অংশে নাগরিক জীবনের অস্তিত্ব ছিল পনেরো শতকের মাঝপর্বেই। অর্থাৎ সুলতানি শাসনযুগে।

 

ঢাকা নগরী

সতেরো শতকের প্রথম দশকে ঢাকা মোগল রাজধানীর মর্যাদা পায়। সেই থেকে গড়ে ও বেড়ে উঠতে থাকে ঢাকা নগরী। মোগলদের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে আইন-ই-আকবরী বৃহত্তর ঢাকা জেলার অবস্থান সম্পর্কে একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবুল ফজলের মতে সরকার বাজুহা ও সরকার সোনারগাঁর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ঢাকার অবস্থান ছিল। অবশ্য সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়, ইসলাম খান চিশতি কর্তৃক ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠার আগে এই অঞ্চলটির নগর হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ ছিল। এদিক থেকে দুটি শিলালিপির সামান্য কিছু বক্তব্য প্রাথমিকভাবে কৌতূহলের উদ্রেক করিয়েছে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এই লিপিভাষ্যগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে উন্মোচিত হয়েছে একটি নতুন দৃশ্যপটের সম্ভাবনা। তাতে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সুলতানি যুগে ঢাকা নগরীর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করার।

প্রাক-মোগল বাংলায় ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন লক্ষ করা না গেলেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনুসন্ধান কয়েকটি দৃশ্যপটের ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান প্রসঙ্গে আমরা ঢাকা নগরীতে প্রাপ্ত দুটি শিলালিপি আলোচনা করার প্রয়াস পাব। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৬-৫৬ খ্রি.) সময় খোদিত এই শিলালিপি দুটির একটি থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় ঢাকা তখন ইকলিম মুবারকাবাদের অন্তর্গত ছিল। বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনাকারী ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সময় থেকেই তাঁর নামানুসারে ইকলিম মুবারকাবাদ নামটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

আমাদের প্রস্তাবিত প্রথম শিলালিপিটি ঢাকার নারিন্দায় একটি মসজিদের গায়ে সাঁটা রয়েছে। দ্বিতীয়টি পাওয়া গেছে বর্তমানে পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের কিছুটা পশ্চিমে গিরিদিকিল্লা নামের মহল্লায় নাসওয়ালাগলি মসজিদের সম্মুখস্থ একটি তোরণের গায়ে। মসজিদ বা তোরণের অস্তিত্ব এখন আর নেই। শিলালিপিটি প্রথমে ঢাকা কালেক্টরেটে ছিল। বর্তমানে তা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। নারিন্দার শিলালিপির সূত্রে জানা যায়, মসজিদটি ৮৬১ হিজরি অর্থাৎ ১৪৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। নাসওয়ালাগলির শিলালিপি উত্কীর্ণের সময়কাল জুন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ। সময়ের হিসাবে দুটি শিলালিপিই সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় উত্কীর্ণ। প্রথম শিলালিপির বক্তব্য বিষয় খুবই সীমিত। লিপি বিন্যাসে বোঝা যায়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয়টিতে মসজিদের সম্মুখস্থ তোরণ নির্মাণের সাক্ষ্য রয়েছে। এটি সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হওয়ায় সমকালীন সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের নাম উত্কীর্ণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে খাজা জাহান নাম লেখা হয়েছে আর নির্মাণ অঞ্চল হিসেবে লেখা হয়েছে ইকলিম মুবারকাবাদ।

মসজিদ দুটির অবস্থান পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় একটি সরলরেখায় প্রায় চার কিলোমিটারের ব্যবধানে। দুটি মসজিদই ইকলিম মুবারকাবাদের অধিভুক্ত অঞ্চলের ভেতর ছিল। পাশাপাশি ইকলিম নিশ্চিত করছে ঢাকার এই অংশে নাগরিক জীবনের স্পন্দন ছিল সুলতানি যুগের প্রথমার্ধেই।

নারিন্দায় প্রাপ্ত আলোচ্য প্রথম শিলালিপিতে নির্মাতার নাম ফারসিতে লেখা হয়েছে। নিজেকে তিনি বিশেষায়িত করেছেন ‘মোসাম্মাৎ বখত বিনত, দুখতারে মারাহমাত গরীব’ বলে, অর্থাৎ মরাহমাতের কন্যা দ্বীন দরীদ্র বখত বিনত এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। শামসুদ্দিন আহমদ তাঁর ‘Inscriptions of Bengal’ (Vol-IV) গ্রন্থে আলোচ্য শিলালিপিটি বিশ্লেষণ করেছেন। শিলালিপিটির বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, এ যুগে মুসলিম সুলতান ও কর্মকর্তারা সাধারণত আরবি ভাষায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবির সঙ্গে ফারসি শব্দের মিশেলে শিলালিপি উত্কীর্ণ করতেন। কিন্তু নারিন্দার এই শিলালিপির ভাষা ফারসি। তুলনামূলকভাবে লিপিগুলোও অদক্ষ হাতে খোদিত। আমাদের মনে হয়, এই একটি মাত্র যুক্তিতেই বখত বিনতের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রথমত, শিলালিপিতে সমকালীন প্রথা অনুযায়ী সুলতান বা কর্মকর্তার নাম না থাকায় মসজিদটি যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়নি তা নিশ্চিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি রীতিতে আরবি শব্দ ব্যবহার না করে এ সময়ের সাধারণ মুসলমানের কাছের ভাষা ফারসিকেই ব্যবহার করা হয়েছে লেখার মাধ্যম হিসেবে। তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত উদ্যোগে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল বলেই সরকারি দক্ষ লিপিকার দ্বারা শিলালিপি খোদিত না হওয়ায় তাতে অদক্ষতার ছাপ দৃশ্যমান হয়েছে।

অন্যদিকে নাসওয়ালাগলির শিলালিপিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘোষণা রয়েছে। তাই দক্ষতার সঙ্গে তা খোদিত হয়েছে আরবি নাস্খ রীতিতে। আগেই বলা হয়েছে, সুলতানের নামের সঙ্গে নির্মাতা হিসেবে খাজা জাহানের নাম উল্লিখিত আছে। তুঘলক যুগে দিল্লিতে প্রধান কর্মকর্তা বা উজিরকে খাজা জাহান উপাধি দেওয়া হতো। সাধারণভাবে সুলতানি যুগে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপাধি ছিল খাজা জাহান। ধারণা করা হয় ইকলিম মুবারকাবাদের শাসনকর্তা ছিলেন এই খাজা জাহান। সুতরাং শিলালিপি দুটি থেকে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়, ঢাকার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পনেরো শতকের মাঝামাঝি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মসজিদ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে এই দৃষ্টান্ত সুলতানি যুগে ঢাকা নগরের বিকাশমান অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তটি আধুনিক ইতিহাসবেত্তাদের চিন্তায়ও স্থান পেয়েছে। এ পর্যন্ত সুলতানি যুগের প্রতিনিধিত্বকারী যেসব শিলালিপি পাওয়া গেছে তার বেশির ভাগেই মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এতে লক্ষ করা যায়, সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ নির্মাণের স্থান ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমান জনবসতির সঙ্গে মসজিদ স্থাপনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তাই মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি মুসলমান সমাজের বিস্তৃতিকেই নির্দেশ করছে।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেছে, পনেরো শতকে ইকলিম মুবারকাবাদের অংশ হিসেবে বর্তমান ঢাকার একাংশে নগরের অবস্থান ছিল। একই সঙ্গে ওপরে আলোচিত শিলালিপি দুটি অন্তত দুটি মসজিদ নির্মাণের সাক্ষ্য বহন করে এই অঞ্চলে মুসলমান জনবসতি সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে। ঢাকা নগরের আশপাশে এর অনেককাল আগে থেকেই মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠা ও শিক্ষা বিস্তার ঘটার বিষয়টি ইতিহাসে প্রমাণিত। আলোচনার শুরুতে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ যুগে মিরপুর অঞ্চলকে ঢাকার উপকণ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এখানে সুফি শাহ আলী বোগদাদীর সমাধি রয়েছে। সমাধি লাগোয়া প্রাচীন মসজিদের গায়ে শিলালিপি পাওয়া গেছে। এতে নির্মাণকাল উল্লিখিত হয়েছে ৮৮৫ হিজরি অর্থাৎ ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং বোঝা যায়, পনেরো শতকের শেষার্ধে ঢাকার আশপাশে মুসলিম সমাজ বিস্তৃত হয়েছিল।