• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ১৩:৫৮:১৬
প্রকাশের সময় :
জুন ২০, ২০২২,
১০:১৮ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
জুন ২০, ২০২২,
১০:১৮ অপরাহ্ন

২৫৩ বার দেখা হয়েছে ।

সিলেটের কান্না : কতকাল অশ্রুত রইবে?

সিলেটের কান্না : কতকাল অশ্রুত রইবে?

প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অঞ্চল সিলেট আজ ক্রন্দনরত। মাস খানেক আগের বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো প্রাকৃতিক বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন এই পূণ্যভূমি। সুরমা নদীসহ নদীর রাজ্যের এই অঞ্চলের বিভিন্ন জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতসহ মৌসুমী প্রভাবের ফলে বছরের প্রায় সময়ই বন্যাকবলিত থাকে। বিগত কয়েক দশক ধরে সিলেট বন্যার কড়াল গ্রাসে দিনাতিপাত করছে, বন্যার সঙ্গে সিলেটের মানুষ এই সহাবস্থান আজকের নয়। বর্ষার সময়টা আর পাশের দেশের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয়ের চূড়া থেকে যেন আতঙ্কের ঝরনা বয়ে আসে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান বন্যায় বর্তমানে প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম, দু শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সিলেট ও সুনামগঞ্জের বহু গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাদ্য, আবাসন, যাতায়াত, চিকিৎসা সেবার সংকটসহ বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছেন পুরো সিলেটবাসী। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা এ মুহূর্তে বন্যায় জর্জরিত। আরো ভয়াবহ অবস্থা, ধারণা করা হয়েছে বিপৎসীমা অতিক্রম করা পানির উচ্চতা, যা সিলেট ও বিশেষত সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে মারাত্মক রূপদান করছে। সিলেটের বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন অফিস, আদালত প্রাঙ্গণ, জনসাধারণের আবাসস্থল পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত। এতে করে সিলেট সুনামগঞ্জের দিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি এবং পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধার সরঞ্জামের বিকট অপর্যাপ্ততা ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমকেও ব্যাহত করছে।

সিলেট-সুনামগঞ্জ বন্যা পরিস্থিতির নাজেহাল অবস্থা ও জনগণের দুর্দশার চিত্র সারা দেশজুড়ে জ্ঞাত। কিন্তু সরকারি পর্যায় থেকে বড় আকারে ঘোষণা জরুরি হলেও তা এখনো পর্যন্ত ঘোষিত হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়ক ‘শৈথিল্য’ ও ‘যথাসময়ে যথোচিত পদক্ষেপ’ এর ঘাটতি সিলেট জেলার বন্যাদুর্গত এলাকার নাজেহাল অবস্থাকে বেগবান করছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির ভিডিও চিত্র সিলেটের পরিস্থিতির করুণ দৃশ্য তুলে ধরেছে, যা তাদের বর্ণনাতীত কষ্টে দিনাতিপাত এর প্রতিচ্ছবি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, সিলেট জেলা প্রশাসক ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন রাখছেন। তবে সিলেট সুনামগঞ্জের ১৬টি উপজেলাসহ ক্রমবর্ধমান পানিবন্দি এলাকার জন্য বন্যাকবলিত মানুষ বাড়ছে। এতে করে এখনো পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না বন্যাকবলিত হাজারো মানুষ। অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষার স্থগিতাদেশ একটি প্রশংসিত পদক্ষেপ। তবে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে জীবন যে বিপন্ন অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে তাতে এখন অস্তিত্ব টিকে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

দুর্যোগ মোকাবিলা যেহেতু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। এহেন জাতীয় বিপর্যয় এ আইনের সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ দুর্যোগ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিকে সবচেয়ে ফলপ্রসূ করতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে আইনি কি বিধান রয়েছে তা জানা জনসাধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। দেশে দুর্যোগ সংক্রান্ত প্রধান আইন একটি হলেও সংশ্লিষ্ট আরো কিছু আইন আছে যা বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পর সম্পৃক্ত। এ লিখনিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যেসব আইন প্রচলিত তার একটি সার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো –

১. স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯

যেকোনো বন্যা পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত এলাকার সার্বিক তত্ত্বাবধানের অন্যতম কর্তব্য বর্তায় সংশ্লিষ্ট এলাকার সিটি কর্পোরেশন এর উপরও। ২০০১ সালে এ মর্মে সিলেট সিটি কর্পোরেশন আইন নামে একটি আইন করা হয়েছিল, যার ১২৯ ধারায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, জরুরি ভিত্তিতে যাতায়াত ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত নৌকা এবং উদ্ধার কাজ চালানোর সব রকম যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও পদক্ষেপ নেওয়ার স্পষ্টত বিধান রাখা ছিল। তবে পরবর্তীতে এ আইনটি বাতিল করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৪১ ধারায় মেয়র ও কাউন্সিলরদের পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বলা আছে। এ ধারা মতে, উক্ত আইনের ৩য় তফসিলে যেকোনো দুর্যোগে সরকারি বিধি ও নির্দেশনা মেনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার যে বিষয়টি উল্লেখ করা আছে তা কর্পোরেশনের মেয়র ও এর স্থায়ী কমিটি তাদের বর্তমান তহবিল সাপেক্ষে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেবে বলে বিধান রয়েছে।

এ আইনের ৫০(১)(ঢ) ধারায় বলা আছে যে, সংশ্লিষ্ট এলাকার সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর কর্পোরেশনের প্রথম সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি গঠন করবে, যা ২ বছর ৬ মাস অন্তর নতুন করে গঠিত হবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না বা এ কমিটি আদৌ কার্যকর আছে কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়।

২. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২

দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হলে সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের। তবে সিলেটে বন্যা ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি ‘জাতিসংঘ জনসেবা পদক’ প্রাপ্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা আরো আগেই আরো ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হওয়া উচিত ছিল।

“দুর্যোগ” বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ২(১১)(অ) ধারায় যার অধীনে বন্যাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে এ ধারায় দুর্যোগ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ আইন এসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত অন্য সব আইনের চেয়ে প্রাধান্য পাবে বলে ধারা ৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এর ২৯ ধারায় দুর্যোগ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা অব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারেন। অর্থাৎ সিলেট সুনামগঞ্জসহ সিলেটের বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কেন এখনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না সে অসন্তোষ প্রকাশ করে অভিযোগ দেওয়ার ও কর্তৃপক্ষের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করারও বিধান রয়েছে। তবে আপিলের পর জেলা প্রশাসক বা বিভাগীয় কমিশনার এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ৯(ক) ধারায় দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কর্মসূচি গ্রহণের বিধান রয়েছে। আইনের ৯(খ) ধারায় ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা, পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন কর্মসূচির যথাযথ পরিচালনা এবং ৯(গ) ধারায় দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও জরুরি সাড়াদান কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমগুলো সমন্বয় সাধনের কথা বলা হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকার জনসাধারণের জীবন বাঁচানোসহ এলাকার মানুষের উদ্ধার সংক্রান্ত সব প্রস্ততি নেওয়ার বিষয়টির সঙ্গ অনেক কমিটি জড়িত। সাড়া সমন্বয় গ্রুপ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, সিটি কর্পোরেশন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি তথা বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থার আঞ্চলিক শাখা ইত্যাদি। এসব সংস্থা ও গ্রুপের মধ্যে সমন্বনয়কারী হিসেবে কাজ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

বিপত্তি হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২৩ ধারায় সরকারি নির্দেশনা প্রদান ও যাবতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কমিটির জরুরি অংশগ্রহণ নির্ভর করছে এ আইনের ২২ ধারার উপর, কেননা ২২ ধারা অনুযায়ী কোনো অঞ্চল যখন দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে তখনই সরকারি নির্দেশনা দেওয়া হবে। অর্থাৎ সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি সরকারের দ্রুত প্রচেষ্টা ছাড়া লাঘব হওয়ার সুযোগ একেবারে নেই।

৩. বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩

উপরোক্ত দুটি আইন ছাড়াও বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর ২৫(১) ধারা বলে সরকার এ আইনের অধীনে গঠিত নির্বাহী কমিটি দ্বারা যেকোন অঞ্চলকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। ২৫(২) ধারায় এ কমিটি ওই অঞ্চলে বন্যার পানি যেন দ্রুত বয়ে যায় তাই জলাধারের পানির গতি নিয়ন্ত্রণ বা পানি প্রবাহে বাধা দেয় এমন কাজকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এ আইনের ২১ ধারায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্থায়িত্ব ও সুরক্ষা বলয় নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিধান রয়েছে।

৪. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (তহবিল পরিচালনা) বিধিমালা, ২০২১

এ বিধি মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ৩২ ধারার বাস্তবায়নে করা। এ বিধিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে একটি জেলা কমিটি থাকে, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিলের অর্থ কাজে লাগিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি তদারকি করবেন। এর ১০ নং বিধি অনুযায়ী তহবিলের অর্থ দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহার করা যাবে। এই প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে রয়েছে-জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিহ্রাস, উদ্ধার কাজ পরিচালনায় উপযুক্ত সরঞ্জামসহ স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত রাখা, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সামগ্রী, খাবার, সুপেয় পানি বিতরণ, নারী-শিশু-বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী নারীর ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ও সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি।

১০ নং বিধির ৩ নং উপবিধিতে বলা আছে, বন্যাদুর্গতদের জীবনধারণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিম্নোক্ত সামগ্রী- চাল, ডাল, আলু, তেল, লবণ, মরিচ, মশলা, চিড়া, গুড়, মুড়িসহ শুকনো খাবার, মোমবাতি, দিয়াশলাই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোশাক ইত্যাদি বিতরণ করতে হবে। পানি শোধনের ব্যবস্থা করা, উদ্ধার কাজে তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য টর্চলাইট, অক্সিজেন, নি-প্যাড, মাস্ক, কোদাল, শাবল, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদির সরবরাহ করা, যৌন হয়রানি নিরোধে পাহাড়া, স্বেচ্ছাসেবক টিম, ফায়ার সার্ভিসের, রেড ক্রিসেন্ট সদস্য ও পুলিশ সদস্য সহ উদ্ধার কাজে সংশ্লিষ্ট সবার খাবার ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া আছে। এছাড়াও দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন এর সব পদক্ষেপ নেওয়ার বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া আছে।

৫. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (কমিটি গঠন ও কার্যাবলী) বিধিমালা, ২০১৫

মূলত এটিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের উদ্দেশ্য সাধনে প্রণীত বিধিমালা যাতে দুর্যোগ মোকাবিলা বৃহত্তর জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন ও তাদের কার্যাবলী সংক্রান্ত বিশদ বিধান ও আলোচনা করা হয়েছে। বিধিলামাতে ইউনিয়ন কমিটি, উপজেলা কমিটি, উপজেলা সমন্বয় গ্রুপ, ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচি বাস্তবায়ন বোর্ডও পলিসি কমিটি, জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা কেন্দ্র, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, জেলা কমিটিও সমন্বয় গ্রুপ, পৌরসভা কমিটি ও সমন্বয় গ্রুপ, সিটি কর্পোরেশন কমিটি ও সমন্বয় গ্রুপ, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি, জাতী উপদেষ্টা কমিটিসহ অন্যান্য কমিটির বিস্তারিত গঠন ও কার্যাবলী বর্ণিত হয়েছে। এ বিধিমালাটি সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ৫৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রণয়ন করেছে।

বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করতে সরকার “বাংলাদেশ পানি সম্পদ অধিদপ্তর আইন, ২০১৯” নামে অতি সম্প্রতি আরো একটি বিল প্রস্তাব করেছে, যা বন্যার পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে বাংলাদেশ পানি সম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় আনতে পারবে এবং এ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় উপভোগকারী সংগঠন এর সঙ্গে চুক্তি করে একযোগে এ বিষয়ে কাজ করবে। বন্যা পূর্বাভাসের ও এর সতর্কতার বিষয়ে এই আইন নির্দেশিকা দেবে।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, বিগত দু মাসে সিলেটের যে বন্যা ক্রমশ বাড়ছিল সেই থেকে বিকট আকার ধারণ করা এ বন্যার পূর্বাভাসের ইঙ্গিত কর্তৃপক্ষ পেয়েছে। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি? তবে কী এই দুর্যোগ মানবসৃষ্ট?

সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যার তাণ্ডব যেন আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় অব্যবস্থাবনা ও ব্যর্থতার মূর্ত প্রতীক। দু’মাস দুর্যোগ পরবর্তী পদক্ষেপ ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকার পুর্নবাসনের জন্য কি যথেষ্ট সময় ছিল না? পানিপ্রবাহ বাঁধ এর সংরক্ষণের জন্য আইনে বর্ণিত বিধিবিধান কতটুক পালন করা হয়েছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের সুরমাসহ অনেক নদী ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া সিলেটকে বন্যাস্পৃষ্ট অঞ্চল হিসেবে পরিণত করতে অনেকাংশে দায়ী। আজকের এই পরিস্থিতির একটি অন্যতম কারণ বহু বছর ধরে বাঁধ নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণে কমতি ও নদী ভরাট দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া। আগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর তৎপরতা প্রশাসনের মধ্যে খুব একটা দেখা যায়নি। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে নদীর পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণে সরকার কবে সজাগ হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ রয়েই যায়।

সরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়ার যে প্রচেষ্টা তা নিতান্তই অপ্রতুল। ২০১৭ সালের বন্যার পরের সময়ে সিলেট সুনামগঞ্জের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হলে আজকের পরিস্থিতির কারণ ও নিরসনের উপায় দু’টোই পর্যালোচনা করা যেত। আইনের অনুসরণ না করা, আইনে বর্ণিত পন্থা ও বিধান অনুসারে যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেওয়া ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটিপূর্ণ হলে এ ধরনের দুর্যোগের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

উপরোক্ত আইন ও বিধিমালায় যেভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মুখ্য ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, এতে নিঃসন্দেহে বলা চলে আমাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত আইনি কাঠামো অনেক শক্তিশালী।

মূল সমস্যা হলো আইনে যতটা ব্যাপক আকারে বিধান ও বিধি সংযোগ করা হয়েছে এর বাস্তবায়ন ততটাই বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলছে।
পর্যাপ্ত সহায়তা ত্রাণ, উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব, স্বেচ্ছাসেবক টিমও জনবলের অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি, কমিটি, সমন্বয় গ্রপের সমন্বয় সাধনের অভাব, তহবিল সমন্বয়ে ঘাটতিসহ নানামুখী সমস্যায় আড়ষ্ট আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মডেল।

আইনে বর্ণিত বিধান পালন, বিধি অনুযায়ী গঠিত তহবিলের সঠিক ব্যবহার, বিধিবর্ণিত ক্ষুদ্রতর থেকে জাতীয় পর্যায়ের কমিটিগুলোর গঠন, দক্ষ পরিচালনা, সমন্বয়সাধন ও বাস্তবায়নই পারে বন্যাসহ যাবতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে।

এক্ষেত্রে “স্লিপিং মিডিয়া” এর বিষয়টিও সমালোচনায় আসতে পারে। বিগত দু মাস ধরে বন্যাপীড়িত এ এলাকা দুটি মিডিয়া মহলের সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত ছিল। জাতীয় ইস্যুতে কর্তৃপক্ষের টনক নড়তে কালক্ষেপণ, পত্রিকার পাতায় জন দুর্ভোগ এর কথার অনুপস্থিতি রেখে চিত্রজগতের ব্যক্তিত্ব ও পদ্মা সেতুর খবর প্রকাশে ব্যতিব্যস্ততা ও গণমাধ্যমের উদাসীনতা যারপরনাই বিস্মিত হওয়ার মতো ব্যাপার।

বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সিলেটের মানুষের আর্তনাদ যেন কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। সিলেটের দুর্গতির চিত্র তুলে ধরার চেষ্টায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অন্যতম তবে শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকায় আরো আগে থেকেই ব্যাপকভাবে খবর প্রচার এর প্রয়োজন ছিল। লাখ লাখ মানুষের বিপন্ন প্রায় অবস্থানকে সুদৃঢ় রূপে তুলে ধরার চেষ্টা কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি বাড়াতে আরো আগে ভূমিকা রাখত।

এক্ষেত্রে জাতীয় দুর্যোগের বিষয় টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রচার ও প্রসার করা উচিত। এ বিষয়ে উক্ত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে এ আইনের ৩৪ ধারায়। এ ধারায় সব গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট মাধ্যমকে দুর্যোগ মোকাবিলা সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ দুর্যোগ সংক্রান্ত খবরাখবর প্রচার প্রকাশ করা এবং জনসচেতনতামূলক তথ্যচিত্র ও সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।

সিলেট সুনামগঞ্জের বর্তমান বন্যার ফলে ইতোমধ্যে ২৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু করা হলেও বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের উদ্ধার খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট পদক্ষেপ এখনো নেওয়া বাকি। যার দরুণ বন্যার ক্রমবর্ধমান পানি জনজীবনে স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। অপর্যাপ্ত ত্রাণ, নৌকা ও উদ্ধার এর অভাব, তহবিল গঠন ও এ থেকে জরুরি ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু করা, কমিটি গঠন ও সমন্বয় না থাকাসহ নানান অব্যবস্থাপনা এ বন্যা পরিস্থিতিকে মর্মান্তিক রূপ দিচ্ছে।

প্রবল বর্ষণে এলাকার কুমারগাওঁ পাওয়ার স্টেশন যা সিলেট ও সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, তা প্রায় জলমগ্ন যা সাধারণ মানুষের জন্য বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। পাওয়ার গ্রিড স্টেশন একেবারে ডুবে গেলে পুরো বন্যাকবলিত এলাকায় একযোগে বিদ্যুৎ সংকটে পড়বে, যা অবস্থাকে আরো বড় বিপদের মুখে ফেলবে। এতে করে বন্যাদুর্গতদের কাছে পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ হবে। এরইমধ্যে সুনামগঞ্জের সঙ্গে পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। রেলপথ ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে প্রয়োজনীয় টিম ও কমিটির সদস্যরা পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছেন, যা ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত করছে।

এ মুহূর্তে সরকার সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোকে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করা তথা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ৩৫ ধারা অনুযায়ী একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর মাধ্যমে এ আইনের তফসিল অংশে বর্ণিত বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, নিরাপত্তা পুনর্বাসনসহ দুর্গত এলাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অতিসত্বর উদ্যোগ নেওয়া যাবে।

যত দ্রুত সম্ভব স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে তদারকির দায়িত্বে আনা যেন বন্যাপীড়িত মানুষের উদ্ধার ও পুর্নবাসন তথা ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করা যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারি সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার আশু ঘোষণা জরুরি অন্যথায় সিলেটের বন্যা পরবর্তী অবস্থা দেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে যা মোকাবিলা করতে সরকারকে বিড়ম্বনা এবং জনসাধারণকে বিপর্যস্ততা পোহাতে হবে। এ জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সরকার, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সব সচেতন নাগরিককে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসা উচিত। এতে করে শিগগিরই আমরা সিলেটের পরিস্থিতি সামলে এর প্রকৃতিও গণমানুষের স্বাভাবিক অবস্থানে ও জীবনযাত্রায় ফিরে আসার প্রয়াসকে অর্থবহ করে তুলতে পারি।

লেখক : ইভনাত ভূঁইয়া, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, রেডলিফ পাব্লিশিং, ঢাকা